ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ১০টা। চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার সুচক্রদণ্ডী গ্রামের কালীবাড়ি আর পল্লি মঙ্গল থেকে শঙ্খ ধ্বনি, ঢোলের আওয়াজ ভেসে আসছে। পটিয়া বন্ধুসভার বন্ধুরা একত্র হই আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের বাড়ি প্রাঙ্গণে।
গ্রামটির নামকরণ বেশ সুন্দর। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলে ‘য়ুঁইচ্যাদাইর’ বা সুইচ্যাদাইর। সুইচ্যা মানে সুচ ব সুচী সুচের মতো। দাইর মানে সীমারেখা। সুইচ্যা ধার থেকে সুচক্রদণ্ডী সু মানে ভালো, চক্র-বৃত্ত দণ্ডী-দণ্ডধারী বা জনপদ। শিক্ষা-দীক্ষা সংস্কৃতি, হিতৈষী, মূল্যবোধ প্রভৃতি দিক দিয়ে সুচক্রদণ্ডী গ্রামটি শিল্প–সাহিত্যে ও সংস্কৃতিতে উর্বর।
১৮৭১ সালে ১১ অক্টোবর এই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন উপমহাদেশবরেণ্য আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। তাঁরই আপন ভাতিজা জ্ঞানতাপস মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গবেষক শিক্ষাবিদ ড. আহমেদ শরীফ, ডা. অন্নদাচরণ খাস্তগীর, শিক্ষাবিদ শামসুল আলম, অধ্যাপক ড. নেহাল করিমসহ আরও অনেক গুণীজনের জন্মভূমি এটি।
সুচক্রদণ্ডী গ্রামের বাতিঘর মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ আড়াই হাজারের অধিক পুঁথি সংগ্রহ, পুঁথি সম্পাদনা, গবেষণা, চার শতাধিক প্রবন্ধ রচনাসহ লুপ্তপ্রায় এক সাহিত্য ভান্ডার চর্চার দিক তুলে ধরে পুরো বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করে গেছেন। পুরো দেশের প্রত্যেন্ত অঞ্চল থেকে বহু দুর্লভ পুঁথি সংগ্রহ করেছেন, যার গবেষণার ফসল আজকের আধুনিক বাংলা সাহিত্য। এই গ্রামে একদা ঘুরে গেছেন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. এনামুল হক, সৈয়দ মুজতবা আলী, কবি আবুল ফজল, ড. হুমায়ুন আজাদ, গবেষক আশুতোষ চৌধুরী, বাংলা একাডেমির অনেক মহাপরিচালক, কবি-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের বাড়িতে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে সাহিত্যবিশারদ ভবন, পুকুরে শানবাঁধানো ঘাটলা, মসজিদের পূর্ব পাশে তাঁর সমাধি। তাঁর ১৫৩তম জন্মবার্ষিকীতে পটিয়া বন্ধুসভার বন্ধুরা ১২ অক্টোবর কবর জিয়ারত ও পুষ্পমাল্য অর্পণ করেন। পুষ্পমাল্য প্রদান শেষে সবাই সাহিত্যবিশারদের বাড়ি পরিদর্শন করেন। ভবনে যাওয়ার পথে মাটির দোচালা টিনের ঘর, খড়ের গাদা, পাকা দেয়ালে ঘেরা সাদা রঙের বাড়ি, বাড়ির পাশে তাঁরই আমলে ব্যবহৃত ঢেঁকির পাথর, কবুতরের খোপ চোখে পড়বে। ঘরের দেয়ালে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ছবি, পোর্ট্রেট, সংগৃহীত বই রয়েছে।
ভবনের অতিথি কক্ষে শুরু হয় ‘শরৎ সাহিত্য আড্ডা’। সাহিত্যবিশারদের দৌহিত্র আকাশ ভাই ধোঁয়া ওঠা চা, গরম চমুচা, বিস্কুট ও কলা দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করালেন। এ সময় আবদুল করিমের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন পটিয়া বন্ধুসভার সভাপতি মানবেন্দ্র ভট্টাচার্য, সহসভাপতি ফারুক আহমেদ, উপদেষ্টা রশীদ এনাম, সাবেক সভাপতি প্রান্ত বড়ুয়া, শিক্ষক কাজী সোহেল, সাধারণ সম্পাদক আইরিন সুলতানা, বন্ধু জয় দে, সাকিবুল ইসলাম, তৌহিদুল ইসলাম ও সুফি মোহাম্মদ রেজা। শরৎ নিয়ে কবিতা আবৃত্তি করেন বন্ধু মাহাবুবা সামিয়া, তাউসিফ রেজা, তানিয়া আকতার, জেবু চৌধুরী, তানাস চৌধুরী ও ইজমা জাহান।
উপদেষ্টা, পটিয়া বন্ধুসভা