‘ঈদের দিন হামরাও সেমাই খামো’

দিনাজপুরে নতুন জামা হাতে নিয়ে শিশুদের উচ্ছ্বাসছবি: অনুপ রায়

ঈদ মানেই খুশি, ঈদ মানেই আনন্দ। রমজান মাস এলেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ঈদের আমেজ। এই আনন্দ ক্রমে বাড়তে থাকে রমজানের শেষ ভাগের দিনগুলোতে। কিন্তু ঈদের আনন্দের সঙ্গে উদ্বেগও বেড়ে যায় নিম্ন আয়ের সাধারণ পরিবারগুলোতে। পরিবারের অবুঝ শিশুটির নতুন জামার বায়নায় চিন্তায় থাকেন মা-বাবা।

এই উদ্বেগকে একটু কমিয়ে সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে মানবতার কল্যাণে কাজ করার মঞ্চ বন্ধুসভার ধারাবাহিক আয়োজন সহমর্মিতার ঈদ। বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের আহ্বানে প্রতিবছর সারা দেশের বন্ধুরা ঈদের খুশি ছড়িয়ে দেন অসংখ্য পরিবারে।

এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে ৫ এপ্রিল ৬০ শিশুকে রঙিন জামা ও ১০০ পরিবারকে খাদ্যদ্রব্য উপহার দিয়েছে দিনাজপুর বন্ধুসভা। সদর উপজেলার মির্জাপুর গোয়ালপাড়া এলাকার নতুন মহল্লায় এগুলো বিতরণ করা হয়।

দিনাজপুর বন্ধুসভার সহমর্মিতার ঈদ
ছবি: অনুপ রায়

উপহারের প্যাকেট খুলে নতুন জামা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয় সোহানা (৬)। তৃতীয় লিঙ্গের সান্ত্বনার পালিত কন্যা সে। মায়ের কাছে অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মেয়েটাকে এত খুশি হইতে আগে দেখিনাই। এখানে প্রতিবেশী সব ছেলেমেয়েদের মধ্যে উপহার পেয়ে খুব খুশি সে। আমারও খুব ভালো লাগতেছে। নতুন জামা গায়ে দিছে, মনে হচ্ছে আজকেই ঈদ।’

প্যাকেট খুলে জামা গায়ে মুড়িয়ে দেখছিল শিশু রাইয়ান ইসলাম (৭)। তার বাবা খলিল উদ্দীন খাবারের হোটেলে কাজ করেন, মা রান্না করেন মেসে। নতুন জামা ও ঈদ উপহারের আনন্দের রেখা ফুটে ওঠে পুরো পরিবারের মুখে।

ঈদের উপহারে পোলাওয়ের চাল দেখে খুশিতে মেতে ওঠেন ষাটোর্ধ্ব খাইরোন্নেসা। উপার্জনের উৎস হিসেবে মহল্লার শেষ প্রান্তে শোবার ঘরের সঙ্গেই কয়েক প্যাকেট বিস্কুট ও আচার ঝোলানো। স্বামীর মৃত্যুর পর বড় বোনসহ এই মহল্লায় আশ্রয় নেন। উপহার পেয়ে এক বন্ধুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা ছাড়া হামাক কায় দেখিবে বা (সম্বোধন)। তোমরা বড় মানুষ হও, আল্লাহ ভালো করুক। রোজার মাসে এইলা পায়া মুই খুব খুশি হইনু।’

দিনাজপুর বন্ধুসভার সহমর্মিতার ঈদ
ছবি: অনুপ রায়

মহল্লার এক ঘরে থাকেন সনাতন ধর্মাবলম্বী প্রেমহরি রায় (৪২)। ঈদের উপহার পেয়ে তিনি জানান, ‘ঈদের দিন হামরাও সেমাই খামো। ছোয়ালাও খুব খুশি। বেটি একটা জামাও পাইছে। চাহামাত্র তো দিবার সামর্থ্য থাকে না, খুব ভালো লাগিল।’

আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল রায়হান। তিনি বলেন, ‘বন্ধুসভা খুব চমৎকার আয়োজন করেছে। আপনারা সৌভাগ্যবান যে এই ছেলেমেয়েরা আপনাদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে এসেছে। এই ভালোবাসা স্বার্থহীন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর এমন মহৎ কাজ আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে। ভালো কাজের অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে প্রতিনিয়ত।’

দিনাজপুর বন্ধুসভার উপদেষ্টা ও বীরগঞ্জ ডায়াবেটিস অ্যান্ড ফুট কেয়ার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা ডা. ডি সি রায় বলেন, ‘দিনাজপুর বন্ধুসভার মানবিক এই কার্যক্রমকে সাধুবাদ জানাই। ফলের আশা না করে কোনো কাজ করে যাওয়াটা অনেক মহৎ কাজ। আমরা যারা ভালো কাজের সঙ্গে থাকতে ভালোবাসি, আমাদের ভালো কাজ আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করি।’

উপদেষ্টা শরীফুল ইসলাম জানান, ‘যাঁদের মাধ্যমে আপনারা আজকের উপহারটুকু পাচ্ছেন, এখানে তাঁদের কোনো স্বার্থ নেই। উদ্দেশ্য শুধু ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করা।’
দিনাজপুর জিলা স্কুলের শিক্ষক শাহাজাহান সাজু বলেন, ‘বন্ধুসভা সব সময়ই ভালো কাজ করে। তাদের এ কাজের অংশ হতে পেরে আমিও আনন্দিত। সব সময় আলোর পথে থেকে এগিয়ে যাব, এই প্রত্যাশা।’

বিতরণ কর্মসূচিতে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর প্রতিনিধি শৈশব রাজু, দিনাজপুর সরকারি কলেজের শিক্ষক জাহিদ সুলতান, রুবেল সরকার, দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজের শিক্ষক আলী ছায়েদ, সারদেশ্বরী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক শাহানাজ পারভীন, আফসানা আক্তার, বন্ধুসভার সহসভাপতি সুব্রত সরকার, সাজেদুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক সুদর্শন চন্দ্র অধিকারী, সাংগঠনিক সম্পাদক মনোরঞ্জন সিংহ, দপ্তর সম্পাদক খেয়া রানী, প্রচার সম্পাদক অনুপ রায়, সাংস্কৃতিক সম্পাদক ব্রততী বিশ্বাস, পাঠচক্র ও পাঠাগার সম্পাদক সুম্মা মেসবাহুন, তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক দিপু রায়, মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক শুভজিৎ, কার্যনির্বাহী সদস্য মুনিরা শাহনাজ চৌধুরী, বন্ধু তাপস পাল, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক জনিউর রহমানসহ অন্যরা।

সভাপতি, দিনাজপুর বন্ধুসভা