বন্ধু মেহেদীর ‘বইঘর পাঠাগার’

দিনের অনেকটা সময় এখন পাঠাগারে ব্যয় করেন মেহেদী হাসান
ছবি: বন্ধুসভা

বাড়ির উঠানে ৩৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৮ ফুট প্রস্থের একটি আধা পাকা ঘর। ভেতরে ৩টি টেবিল ও ১৫টি চেয়ার। চেয়ারে বসে কয়েক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। তবে কোনোটাই পাঠ্যবই নয়। কেউ পড়ছে উপন্যাস, কেউ গল্পের বই, আবার কেউ মনীষীদের জীবনীগ্রন্থ। আর দেয়ালে কাঠের দুটি আলমিরাতে থরে থরে সাজানো হাজারের অধিক বই। পাঠাগারের নাম ‘বইঘর পাঠাগার’। একজন কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীর নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলা।

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের টেংগরজানি গ্রাম। সেই গ্রামে বাড়ি মেহেদী হাসানের। গাইবান্ধা সরকারি কলেজের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। ২০২০ সালের ৬ এপ্রিল যখন পাঠাগারটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেন, তখন তিনি এইচএসসি ফলপ্রার্থী। নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা ১৭৭টি বই দিয়ে শুরু করেন পাঠাগার। পরে বন্ধু, সহপাঠী, পাড়া–প্রতিবেশী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে সহায়তা চাইলে তাঁরা ব্যাপক সাড়া দেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বর্তমানে বইসংখ্যা ১ হাজার ১৩৮। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর পাঠাগারটি গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত হয়।

পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডেও জড়িত আছেন মেহেদী হাসান। গাইবান্ধা বন্ধুসভার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। পাঠাগার তৈরির ইচ্ছাটা তাঁর ছোটবেলা থেকেই। গাইবান্ধা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একদিন সহপাঠীদের সঙ্গে সরকারি গণগন্থাগারে যান মেহেদী হাসান। পাঠ্যবইয়ের বাইরে যে জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার রয়েছে, তা সেদিনই তাঁর সামনে উন্মোচিত হয়। তিনি বলেন, ‘স্কুল ছুটির পর প্রায় দিনই গণগ্রন্থাগারে গিয়ে বই পড়তাম। এভাবেই অভ্যাস গড়ে ওঠে। কিন্তু গ্রামে ছেলেমেয়েদের জন্য বই পড়ার তেমন কোনো সুযোগ–সুবিধা নেই। তখন থেকেই মনে হতো গ্রামে একটি পাঠাগার করতে পারলে সবাই পড়ার সুযোগ পাবে।’

প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসা ও নাশতার জন্য বাবার কাছ থেকে যে টাকা পেতেন, সেটি জমিয়ে বই কিনতেন। বাবা গ্রামে একটি ওষুধের দোকান চালান। সেটির আয় দিয়ে মা, ও তিন ভাই ও এক বোনের সংসার চলে। একটি সময় হাত খরচ চালানোর জন্য মেহেদী টিউশন শুরু করেন। সেখান থেকে কিছু অর্থ জমিয়ে বইয়ের পেছনে ব্যয় করতেন। এভাবেই ধীরে ধীরে নিজের সংগ্রহে বই জমা হতে থাকে। পাঠাগারের জন্য আসবাব, বই রাখার আলমিরাসহ সবই কিনেছেন নিজের টাকায়। বলেন, ‘করোনার সময় শুরুর দিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে গ্রামের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। চিন্তা করতে থাকি কীভাবে সবাইকে আবারও বইমুখী করা যায়। একদিন মনে হলো আমার কাছে যত বই আছে, সেগুলো দিয়ে একটি পাঠাগার শুরু করা সম্ভব। সবার সঙ্গে কথা বললাম, তাতে সায়ও মিলেছে বেশ। তারপর আরও অনেকে বই দিয়েছে। এভাবেই পথচলা শুরু।’

পাঠাগারের শিশুতোষ গ্রন্থ থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সাহিত্য, বিনোদন, রাজনীতি, অর্থনীতি, উপন্যাস, প্রবন্ধ, রচনাসমগ্র, জীবনী, ছোটগল্প, কবিতা, ভাষাতত্ত্বসহ সাহিত্যের সব ধারার বই রয়েছে। প্রতিদিন আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৫-৩০ জন পাঠক এসে নিয়মিত বই পড়েন।

শহরে বই পড়ার সুযোগ কমবেশি সবাই পান। কিন্তু গ্রামের মানুষ ইচ্ছা থাকলেও সেই সুযোগ পান না। মেহেদী হাসান বলেন, ‘বর্তমানে ছেলেমেয়েরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধিক সময় ব্যয় করছে। বই থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তা ছাড়া দেশের বেশির ভাগ পাঠাগার শহরকেন্দ্রিক। গ্রামের আগামী প্রজন্মকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতেই এই উদ্যোগ।’

সাবেক সভাপতি, গাইবান্ধা বন্ধুসভা