ভ্রমণ, মাত্র একটি শব্দ হলেও এটিতে লুকিয়ে থাকে নতুন মানুষ, তাঁদের সংস্কৃতি আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের গল্প। ভ্রমণ মানে আনন্দের সঙ্গে নতুন কিছুর অভিজ্ঞতা অর্জন। এই আনন্দ যখন বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে, তখন আমরা তার অভিজ্ঞতার গল্পে মেতে উঠি। অন্যের কাছে সেই অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করি। সুমদ্রের ঢেউয়ের শ্রুতিমধুর সুরের টানে ড্যাফোডিল বন্ধুসভার বন্ধুরা এবার তেমনই অভিজ্ঞতা অর্জন করল।
ঢাকা থেকে ৪১৪ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত, যার দৈর্ঘ্য ১২০ কিলোমিটার। এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম অখণ্ডিত সমুদ্র সৈকত। এর বৈশিষ্ট্য হলো পুরো সমুদ্রসৈকতটি বালুকাময়, কাদার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। বালিয়াড়ি সৈকতসংলগ্ন শামুক-ঝিনুকসহ নানা প্রজাতির প্রবালসমৃদ্ধ বিপণি বিতান, অত্যাধুনিক হোটেল-মোটেল-কটেজ, নিত্য নবসাজে সজ্জিত বার্মিজ মার্কেটগুলোতে পর্যটকদের বিচরণে কক্সবাজার শহরে পর্যটন মৌসুমে প্রাণচাঞ্চল্য থাকে।
১৬ অক্টোবর, রাত তখন ১১টা। ধানমন্ডির কলাবাগান থেকে একদল বন্ধু রওনা দেয় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশে। সবার চেহারায় প্রাণের স্ফুরণ ও প্রবল ভাবাবেগ। কেউ ড্যাফোডিল বন্ধুসভার হয়ে প্রথমবার যাচ্ছে, কেউ প্রথম কোনো সমুদ্রসৈকতের অভিজ্ঞতা নিতে যাচ্ছে, আবার কেউ দ্বিতীয়বার বা তারও বেশি। সবার মধ্যে প্রবল উচ্ছ্বাস। ভ্রমণে সঙ্গী হয়ে এই আনন্দ উচ্ছ্বাসকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেন পুরোনো বন্ধুরাও।
তীব্র যানজটের শহর ঢাকা ছেড়ে বাস যখন মেঘনা পার হচ্ছিল, বন্ধুদের মধ্যে তখন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের জোয়ার। গিটারের সুরে, ঢোলের তালের সঙ্গে গানের শব্দে মুখর পুরো বাস। নাচ, গান ও আড্ডায় মুখর হয়ে ওঠে আমাদের যাত্রাপথ। এদিকে গাড়ি চলছে তার নিজস্ব গতিতে; জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিতেই মনে হলো পূর্ণিমা রাতে কুয়াশার ছোয়া। রাত দুটার দিকে কুমিল্লার বিখ্যাত নুরজাহান হোটেলে দেওয়া হয় ২০ মিনিটের যাত্রাবিরতি; সেখানে সবাই খাওয়াদাওয়া করেন। যাত্রাবিরতি শেষে আবারও বাস চলতে থাকে। ১৭ অক্টোবর সকাল ১১টায় কক্সবাজার পৌঁছে নির্দিষ্ট হোটেলে চেক-ইন করে সবাই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন।
বিশ্রামের পর পাশেই একটি রেস্টুরেন্টে সামুদ্রিক মাছ দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নেয় সবাই। এরপর চারটি চাঁদের গাড়ি ভাড়া করে বন্ধুদের দল ছুটল পাটুয়ার টেক সৈকতের উদ্দেশে। বেলা ২টায় যাত্রা শুরু হয়। সবাই হই-হুল্লোড় করতে করতে প্রথমে পৌঁছে যায় হিমছড়ি, এরপর লাল কাঁকড়ার সৈকত বা ঝাউবনে। সেখানে বন্ধুরা নেমে ছবি তুলেন, সৈকত ঘুরে দেখেন, এরপর আবার যাত্রা শুরু হয়। সন্ধ্যা ছয়টায় পৌঁছে যায় পাটুয়ার টেক। পূর্ণিমার চাঁদ ও সমুদ্রে জোয়ার—এমন মনোরম দৃশ্য সবাই উপভোগ করেন। সেখানে সন্ধ্যার হালকা নাস্তা করে আবারও কক্সবাজার শহরে ফিরে আসা।
যার যার রুমে ফিরে সবাই গোসল করে রেডি হয়ে আবার বেরিয়ে পরেন। রাতে আয়োজন করা হয় সামুদ্রিক মাছে বারবিকিউ। ব্লাক স্যালমন ও বড় বড় কোরাল মাছে বারবিকিউ, সঙ্গে পরোটা। খাওয়াদাওয়া শেষে বন্ধুরা সমুদ্রসৈকতে ঘুরেফিরে যার যার মতো মার্কেট করে মধ্যরাতে আবার রুমে ফিরে যান। প্রতিটা রুমে অতি চমৎকার দৃশ্য। এক রুমে বসেছিল গানের আসর, কেউ কেউ পরের দিনের পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত, আবার কেউ ঘুমের ঘোরে।
দ্বিতীয় দিনের প্রথম পরিকল্পনা ছিল সূর্যোদয় দেখা। ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবাই মিলে যাই পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতে। যেখান থেকে সূর্যোদয় খুব ভালোভাবে দেখা যায়। এরপর রুমে ফিরে সকালের নাস্তা করে আবার প্রস্তুত হয়ে চলে যায় সমুদ্রসৈকতে। সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুলে সাগরের ঢেউয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একসঙ্গে সমুদ্রে আনন্দ গোসলের পর হোটেল রুমে গিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নেন। হোটেল থেকে চেকআউট করে বিকেল সাড়ে চারটার ভেতর সবাই নির্দিষ্ট বাসে ওঠেন। এবার ঢাকায় ফেরার পালা।
বাসের মধ্যে ২০২৩ কমিটির সভাপতি নাজমুল অভি সবার মনোরঞ্জন করতে গান গেয়ে শোনান। তাঁর সঙ্গে সুর ধরেন অন্য বন্ধুরাও। গানের তালে তালে আমাদের বাসও চলতে থাকে। চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেলে। টানেলে প্রবেশের আগেই মূহুর্তটিকে ধরে রাখতে অনেকেই মোবাইল ক্যামেরায় ভিডিও ধারণ করেন। টানেল পার হওয়ার পরপরই পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত। সেখানে নেমে সবাই সামুদ্রিক সুরমা মাছ দিয়ে রাতের খাবার খান।
ঘড়িতে তখন রাত একটা। খাওয়াদাওয়া পর্ব শেষ— এমন মুহূর্তে হাজির হন চট্টগ্রাম বন্ধুসভার একদল বন্ধু। একে অপরের সঙ্গে পরিচয় পর্বের পর শুরু হয় সাংগঠনিক আড্ডা। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম বন্ধুসভার উপদেষ্টা শিহাব জিসান, সভাপতি ইব্রাহিম তানভীর ও ড্যাফোডিল বন্ধুসভার সভাপতি সাব্বির আহমেদ।
সাংগঠনিক আড্ডা শেষে চট্টগ্রাম বন্ধুসভার বন্ধুদের বিদায় দিয়ে আবারও বাসে উঠে পড়েন সবাই। এবার সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে যান। ১৯ অক্টোবর সকাল ছয়টায় বাস সাভারের সিএনবিতে সবাইকে নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে যে যার গন্তব্যে চলে যান।
ভ্রমণ আয়োজনে সমন্বয়ক হিসেবে ছিলেন সভাপতি সাব্বির আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক সাবিরা সুলতানা, অর্থ সম্পাদক নাজমুল হাসান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকরামুল ইসলাম, সহসভাপতি আদিবা জামান চৌধুরী, দপ্তর সম্পাদক নাবিল মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক অদিত আল নাফিউ, ম্যাগাজিন সম্পাদক সালমান ফারসি, কার্যনির্বাহী সদস্য সাদমান হোসেন, রাইয়ান শিকদার, তানহা তাসনিম ও শেখ আল মুসাভভির।