বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন যমজ দুই ভাইকে হুইলচেয়ার উপহার

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে দুরারোগ্য ব্যাধি ডিএমডিতে আক্রান্ত যমজ ভাই জামাল ও কামালকে হুইলচেয়ার উপহার দিয়েছে কিশোরগঞ্জ বন্ধুসভাছবি: বন্ধুসভা

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জে দুরারোগ্য ব্যাধি ডিএমডিতে আক্রান্ত যমজ ভাই জামাল ও কামালকে হুইলচেয়ার উপহার দিয়েছে কিশোরগঞ্জ বন্ধুসভা। ১ এপ্রিল বন্ধুরা তাঁদের বাড়িতে গিয়ে একটি হুইলচেয়ার, টি-শার্ট, মা রেশেনা খাতুনকে শাড়ি ও বাবা আদম আলীকে লুঙ্গি উপহার দেন।

বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদের আহ্বানে ‘সহমর্মিতার ঈদ’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এগুলো উপহার দেওয়া হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর প্রতিনিধি তাফসিলুল আজিজ, বন্ধুসভার সভাপতি মোস্তাফিজ মারুফ, সাধারণ সম্পাদক নুসরাত জাহান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাহিদুল ইসলাম, সহসাংগঠনিক সম্পাদক আয়েশা হাবিবা, পাঠচক্র ও পাঠাগার সম্পাদক সাজেদুর রহমান, স্বাস্থ্য ও ক্রীড়া সম্পাদক জিসান রিয়াজ, বন্ধু রায়হান সিদ্দিক ও তাহমিনা আক্তার।

উপজেলার মরিচখালী ও মোকামবাড়ি এলাকায় ২০টি পরিবারকে ঈদের খাদ্যসামগ্রী কিনে দেন বন্ধুরা
ছবি: বন্ধুসভা

স্থানীয় ও পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, আদম আলী ও রেশেনা খাতুন দম্পতির ছয় সন্তানের পর জন্ম নেয় যমজ দুই ছেলে। একসঙ্গে হওয়ায় মা-বাবা আদর করে দুই ছেলের নাম রাখেন জামাল ও কামাল। জন্মের পাঁচ বছর পর্যন্ত সুস্থ ছিল তাঁরা। কিন্তু পাঁচ বছর পর থেকে অজানা এক রোগে দুই ভাইয়ের মাংসপেশি শুকিয়ে পা চিকন হয়ে যেতে থাকে। হারাতে থাকে স্বাভাবিক চলাফেরার শক্তিও। এভাবেই একসময় জামাল ও কামাল পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে যান। শারীরিক প্রতিবন্ধী দুই ছেলেকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন মা–বাবা।

কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকা ইন্দা উত্তরহাটি এলাকায় আদম আলী ও রেশেনা খাতুন দম্পতির বাড়ি। ২০০৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন জামাল মিয়া (২০) ও কামাল মিয়া (২০)। হাওরের প্রত্যন্ত এলাকায় তাঁদের বসবাস।

এখান থেকেই প্রতি মাসে দুই থেকে তিনবার কিশোরগঞ্জ সদরের যশোদল এলাকায় শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য তাঁদের আসতে হয়। সেই সঙ্গে পড়াশোনার জন্য যেতে হয় মাদ্রাসায়। তবে এখন বাড়িতে যাওয়ার ওই রাস্তা বেহাল হওয়ায় তাঁরা কয়েক দিন ধরে করিমগঞ্জের আমলিতলা এলাকায় বসবাস করছেন। সেখানে গিয়েই বন্ধুসভার বন্ধুরা তাঁদের হাতে উপহারসামগ্রী তুলে দেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বন্ধু আর্থিক সহায়তা করেন। এ ছাড়া একই দিন বন্ধুরা উপজেলার মরিচখালী ও মোকামবাড়ি এলাকায় ২০টি পরিবারকে ঈদের খাদ্যসামগ্রী কিনে দেন।

উপজেলার মরিচখালী ও মোকামবাড়ি এলাকায় ২০টি পরিবারকে ঈদের খাদ্যসামগ্রী কিনে দেন বন্ধুরা
ছবি: বন্ধুসভা

জামাল ও কামাল ডুশেন মাসকুলার ডিসট্রফি (ডিএমডি) রোগে আক্রান্ত। কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আতাউর রহমান বলেন, ‘ডিএমডি রোগ হলো একটি জন্মগত রোগ। জন্মের সময় বোঝা না গেলেও কিছুদিন পর থেকে মাংসপেশি শুকিয়ে যেতে থাকে। একসময় হাঁটাচলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই।’

পরিবার সূত্রে জানা যায়, ১৫ বছর ধরে দুই ছেলেকে নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আদম আলী ও রেশেনা খাতুনকে। রেশেনা খাতুনের অন্য ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে না পারলেও জামাল ও কামালকে উচ্চশিক্ষিত করাতে চান। আদম আলী দীর্ঘদিন ধরে কিডনি, হার্ট ও শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছেন। বাকি ছয় সন্তান যাঁর যাঁর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। জামাল ও কামালের সব দেখভাল মা রেশেনাকেই করতে হয়। কোলে করে দুই ছেলেকে শৌচাগারে নিয়ে যেতে হয় পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারীকে। দুই ছেলের শারীরিক পরিচর্যাও করতে হয়। সংসারের টানাপোড়েনে রেশেনার অন্য সন্তানেরা ছোটবেলা থেকেই অর্থ উপার্জনের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে তাঁরা পড়ালেখা করতে পারেননি। তবে রেশেনার ইচ্ছা, তিনি যত দিন বেঁচে থাকবেন, তত দিন জামাল ও কামালকে পড়াবেন। প্রথমে দুই সন্তানকে মা কোলে করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যেতেন। পরে বেয়ারিংয়ের গাড়ি বানিয়ে সেই গাড়িতে করে দুই ছেলে বিদ্যালয়ে নিয়ে যান। এখন হুইলচেয়ার ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা করে বাড়ি থেকে প্রায় পাঁচ থেকে সাত কিলোমিটার দূরে উরদিঘী দাখিল মাদ্রাসায় নিয়ে যান। সেখানে দুই ভাই নবম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছেন।

রেশেনা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, প্রায় চার বছর ধরে তাঁর দুই সন্তান বমির সমস্যায় ভুগছেন। খাওয়ার পর কোনো কিছু তাঁদের হজম হচ্ছে না। এক ছেলের কোনো সমস্যা হলে অন্য ছেলেও একই সমস্যায় ভোগেন।

রেশেনা আরও বলেন, তাঁর পাঁচ ছেলে ও তিন মেয়ে। এর মধ্যে সবার ছোট যমজ জামাল ও কামাল। তাঁদের জন্য প্রতি মাসে ওষুধ খরচ বাবদ চার হাজার টাকা লাগে। মাদ্রাসায় যাতায়াত ও মাসে অন্তত দুবার হাসপাতালে যাওয়া-আসা করতে অনেক খরচ। সংসারই চলে না, এত খরচ কীভাবে চালাবেন—ভেবে কোনো কূলকিনারা করতে পাচ্ছেন না তিনি। তাঁদের আগে দুটি হুইলচেয়ার ছিল। এর মধ্যে একটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এক হুইলচেয়ারে দুজন চলাচল করতে পারত না। এতে খুব সমস্যা হতো। এখন বন্ধুসভার পক্ষ থেকে একটি নতুন হুইলচেয়ার দেওয়ায় তিনি ও তাঁর ছেলেরা খুব খুশি।

বন্ধু, কিশোরগঞ্জ বন্ধুসভা