শহর আলীর রোজা থাকা

ল্যাম্পপোস্টের নিচে হাজারো গল্প জমা হয়ছবি: সংগৃহীত
শহর আলী কীভাবে, কোথা থেকে এসেছে, তা নিজেও জানে না। প্রকৃতির নিয়মে বড় হচ্ছে শুধু এটা জানে। অন্যান্য প্রাণীও যেমন বাঁচে, শহর আলীও তেমন বাঁচে।

শহর আলী রোজা আছে। কয়েক বছর ধরে সব কটি রোজা থাকে। রোজা থাকলে ওর ভালো লাগে। নিজেকে আর দশজন মানুষের মতোই মনে হয়। রোজা থাকলে সবাই মূল্যায়ন করে। কেউ কিছু বলে না। একটু-আধটু সম্মান পাওয়া যায়। এ জন্যই এ মাসটি তার কাছে এত প্রিয়।

শহর আলীর জীবন রোজা থাকলেও যেমন, রোজা না থাকলেও তেমন। পেট ভরে খুব একটা খাওয়া হয় না। পেট পুরে খাওয়ার মতো পরিবেশ, পরিস্থিতি বা সামর্থ্য তার নেই। সে মধুখালী রেলস্টেশনে থাকে। রেলস্টেশনের যাত্রীছাউনিই তার বাস। ঘরবাড়ি সবকিছু। ওখানেই থাকে, খায়দায়, ঘুমায়। খাওয়া বলতে চেয়ে চিনতে যায় পায় তাই। রেলস্টেশনের পাশে পুরোনো একটা ঘর আছে। অনেক আগে স্টেশনমাস্টারের কামরা ছিল। এখন পরিত্যক্ত পড়ে আছে। ওখানেই একটা রেললাইনের পরিত্যক্ত জিনিসপত্রের ওপর একটা কম্বল বিছিয়ে রাতে ঘুমায়। সারা দিন স্টেশনের আশপাশে ঘুরে ঘুরে ভিক্ষা করে আর মানুষের ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র কুড়িয়ে জমা করে।

যেখানে থাকে ওখানেই স্তূপ করে রাখে। এক বস্তা হলে পুরোনো ভাঙারি দোকানে বিক্রি করে দেয়। যেদিন বিক্রি করে সেদিন মোটামুটি খাওয়া ভালো হয়। দুই শ-দেড় শ টাকা পায়। কোনো দিন একটু বেশিও পায়। সেদিন তার রান্না হয়। মানে নিজে রান্না করে। অল্প কিছু তরকারি, অল্প কিছু মাছ, সামান্য টাকায় যা হয় তা নিয়ে এসে থাকার জায়গায় রাতে বসে বসে রান্না করে, মজা করে খায়। ওর কাছে সেদিন ঈদের আনন্দ মনে হয়। সেদিন ঘুমও ভালো হয়। শহর আলীর খুব একটা চিন্তা নেই। খাওয়ার চিন্তাটাই ওর বড় চিন্তা। তা ছাড়া কোনো চিন্তা নেই। মা নেই, বাবা নেই।

শহর আলী কীভাবে, কোথা থেকে এসেছে, তা নিজেও জানে না। প্রকৃতির নিয়মে বড় হচ্ছে শুধু এটা জানে। অন্যান্য প্রাণীও যেমন বাঁচে, শহর আলীও তেমন বাঁচে। বেঁচে থাকে। শহর আলী যেখানে ঘুমায়, তার পাশে একটা কুকুর থাকে। সারা দিন যখন অবসর পায় বা ভালো লাগে, তখন কুকুরটি আসে। কিছুক্ষণ বড় একটা জিহ্বা বের করে হাঁপায়, তারপর ঘুমিয়ে পড়ে।

দারুণ মিল শহর আলীর জীবনের সঙ্গে। কুকুরটিরও কেউ নেই। শহর আলীরও কেউ নেই। একই জায়গায় বসবাস করে। চিন্তামুক্ত দুই প্রাণী। এমনই-বা কয়জন আছে। তবে কুকুরটির সঙ্গে শহর আলীর সখ্য নেই। দুজনের কেউ কাছাকাছি আসে না। ভাবের বিনিময় হয় না। কে কোথায় কী করে, খোঁজখবর রাখে না। তবে প্রতি রাতে তাদের দেখা হয়ে যায়। চোখাচোখি হয়। দুজনই পরিচিত। স্টেশনে কখনো দেখা হলে পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে কুকুরটি। শহর আলী তেমনটি করে না। ভাব বিনিময় করে না। পানে পাত্তা দেয় না। শহর আলীর নামটি কে রেখেছে, তা সে জানে না। তবে নামটি ওর ভালো লাগে। অন্তত মনে হয় শহরে আছি এমন ভাবে। মধুখালী তো একটা উপজেলা শহরই। এখানেই থাকে, এখানেই বাস। সে হিসেবেই হয়তো কেউ তার নামটি রেখে দিয়েছে। নামটি রাখার জন্য তাকে মনে মনে ধন্যবাদ জানায়। মাঝেমধ্যে মা–বাবার কথা ভাবে। কারা তার মা-বাবা? পরে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়; যা নেই তা নিয়ে ভেবে লাভ কী!

অহেতুক মনে কষ্ট পাওয়া; তাই আর ও বিষয় নিয়ে ভাবে না। শহর আলী কোনো কিছুই নিয়ে ভাবে না। নামটা নিয়ে ভাবে। যেহেতু নাম তার শহর আলী। তাই সে মুসলমান। তা ছাড়া সে হিন্দু নাকি মুসলমান নাকি বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কিছুই জানে না। নামের জন্যই নিজেকে মুসলমান হিসেবে ধরে নিয়েছে সে।

সে কোনো সুরা-কেরাত পারে না। নামাজ পড়তে গেলে মানুষের সঙ্গে শুধু ওঠবস করে। মসজিদে গেলে তার ভালো লাগে। এই একটা জায়গা খুবই শান্তির জায়গা। সবাই যে মানুষ, তার একটা মূল্যায়ন হয়। ধনী-দরিদ্র বাছবিচার নেই। সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায়। তখন নিজেকে মানুষ ভেবে গর্ববোধ হয়। মুসলিম ধর্মটাকে ধন্যবাদ জানায়। মন থেকে সালাম জানায়। শুক্রবারে শুক্রবারে নামাজ পড়েই জেনেছে, নামাজ পড়তে হবে। মুসলমানদের চেনার একমাত্র উপায় নামাজ পড়া। তা ছাড়া নামাজের হিসাব নেওয়া হয়। নামাজ পড়লে বেহেশত পাওয়া যায়। বেহেশত হলো চরম সুখের স্থান। এখানে তো সেই সুখটা পাওয়া হলো না। তাই সে পরকালের সুখের জন্য এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। রোজার গুরুত্ব সেখান থেকেই শিখেছে।

রোজা থাকলে আরেকটি বিষয়, মসজিদে ইফতারি দেয়। রোজা না থাকলে দেয় না। তাই রোজা থাকার প্রতি তার ঝোঁক। ইফতারের সময় ফলমূল, খেজুর, শরবত পাওয়া যায়। যা সে কখনো খায় নাই, তা–ও খাওয়া হয়। শহর আলী ভাবে, মুসলমান হয়ে ভালোই হয়েছে; অন্তত একটা মাস খুব ভালোমন্দ খাওয়া যায়। খিচুড়ি, বিরিয়ানি অনেক কিছুই খাওয়া যায়। পেট ভরে খেয়ে আবার সাহ্‌রির জন্য চেয়েও নিয়ে যায়। রেলস্টেশনের সামনের মসজিদের মুসল্লিরা এখন শহর আলীকে চেনে। তাই তাকে সাহ্‌রি খাওয়ার জন্য বেশি করে খাবার দিয়ে দেয়। শহর আলীর মনে আনন্দের ঝিলিক ফুটে ওঠে। পেট পুরে খাওয়ার আনন্দ। রোজা থাকাও হয়, আবার পেট ভরে খাওয়াও যায়।  শহর আলী ভাবতে থাকে এভাবে সারা বছর রোজা থাকলে, কত ভালোই না হতো। ছোট মানুষ। ছোট চিন্তা। খাওয়াকেই জীবনের প্রধান কিছু মনে করে সে। খাওয়া ছাড়া জীবনের আর কিছু যে আছে, তা শহর আলীর ভাবনার মধ্যে নেই। কিন্তু সেই খাওয়াটাই অপূর্ণ থেকে যায় তার জীবনে।

শহর আলী কখনো স্কুলে যায়নি। লেখাপড়া সম্পর্কে তার ধারণা নেই। মক্তবে গিয়ে আরবি শিক্ষা দেয়নি কেউ। তবে দুটি সুরা সে মুখস্থ করেছে। সেই সুরা দুটি দিয়েই নামাজ পড়ে। ধর্– কর্ম যা যা কিছু, তার ও সুরা দুটিই।

তার ইচ্ছা হয় লেখাপড়া করার। কিন্তু নিয়তি সেই সুযোগ দেয়নি। শহর আলীর সে বিষয়ে আফসোসও নেই। তবে রোজা থেকে ইফতারের পর আরও অনেক কিছুই খেতে ইচ্ছে করে। গরম গরম চপ, বেগুনি, ভেজে রাখা চিংড়ি মাছ, হালিম। মাঝেমধ্যে দোকানের পাশ দিয়ে ঘুরে আসে। কিন্তু চাওয়ার সাহস হয় না। চাইলে কেউ দেবে না। বরং দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে। তাই শুধু দেখে আর ঘ্রাণ নিয়ে নিজের ভেতরের খাবার ইচ্ছাটা পূরণ করে শহর আলী। অসাধারণ চিন্তাভাবনা।

এই তো সেদিন কুড়ানো বোতল আর অন্যান্য ফেলনা জিনিসপত্র ভাঙারি দোকানে বিক্রি করে ৭৫ টাকা পেয়েছিল। সেদিন তার দই আর হালিম খেতে ইচ্ছা করেছিল। হালিম কেমন স্বাদ, সে জানে না। তার বয়সী অনেকেই খায়। খুব তৃপ্তি ভরে খেতে দেখেছে। এই জন্যই ভাবে কত না জানি স্বাদ। তাই হালিম খাওয়ার প্রবল ইচ্ছা।

ইফতারের পর হালিম খেতে যায় শহর আলী। দোকানদারকে হাফ বাটি হালিম দিতে বলে। এক বাটি হালিমের দাম দেড় শ টাকা, কয়েক দিন আগেই দাম জেনে গেছে সে। দোকানদার হালিম দিতে দেরি করলে শহর আলী বলে ভাই, আমাকে হাফ বাটি হালিম দেন।

দোকানদার বলে, যা তোর হালিম খেতে হবে না। তোর কি টাকা আছে? অনেক লোক সেখানে। হালিম খাচ্ছে কেউ কেউ। শহর আলী বলল, আমার কাছে পঁচাত্তর টাকা আছে। দোকানদার ধমক দিয়ে বলল, তোর হালিম খেতে হবে না। তোকে দেওয়ার মতো বাটি আমার নাই।

শহর আলী অনেকটা লজ্জা পেল। সব মানুষ তার দিকে তাকিয়ে রইল। এক পা-দুই পা করে শহর আলী পিছিয়ে যাচ্ছে, আর ভাবছে আমার হালিম খেতে মানা। টাকা থাকলেও আমার হালিম খেতে নেই। খাওয়ার জন্য বাটি ওনার কাছে নেই।

শহর আলী হাঁটতে হাঁটতে সেই পরিত্যক্ত কামরায় চলে আসে। এসে দেখতে পায় সাহ্‌রি খাওয়ার জন্য যে খাবার এনেছিল, সেই খাবার কুকুরটি খাচ্ছে। শহর আলী অবাক হয় না। মনে মনে বলে তুই আর আমি একই প্রাণী। তোর জন্য কারও প্লেট–বাটি নেই। আমারও খাওয়ার জন্য কারও কাছে বাটি নেই। কুকুরের খাওয়া বাকি খাবারগুলো শহর আলী তুলে নেয় শেষ রাতে সাহ্‌রি খাওয়ার জন্য।

মধুখালী, ফরিদপুর