মৈনট ঘাট পেরিয়ে, পদ্মার ঢেউ এড়িয়ে উৎসবমুখর দিন

কেরানীগঞ্জ বন্ধুসভার ঘুড়ি উৎসবছবি: বন্ধুসভা

ভোরের শিশির হলো সঙ্গী যে আজ, কেরানীগঞ্জ বন্ধুসভা পদ্মার চরে তুলবে আওয়াজ। বার্ষিক বনভোজন ও ঘুড়ি উৎসবকে কেন্দ্র করে এক সপ্তাহ আগে থেকেই চলছিল আমাদের প্রস্তুতি। প্রথমে সভা আহ্বান করে ভ্রমণের স্থান নির্ধারণের পর চোখে স্বপ্ন এঁকে গুনতে থাকি প্রতীক্ষার প্রহর।

পরদিন ভোরেই উপদেষ্টা রতন ভাইয়ের সঙ্গে চলে যাই সভায় নির্ধারিত স্পট দোহার উপজেলার মিনি কক্সবাজার খ্যাত মৈনট ঘাট ও প্রমত্ত পদ্মার ওপারে অবস্থিত ছায়া সুনিবিড় বিশুদ্ধ বাতাসের পল্লি ‘চর শালিপুর’। মুগ্ধ নয়নে শীতলায়িত হৃদয়ে ভ্রমণ স্থান পরিদর্শন করে ঢাকায় ফিরে এসে গুনতে থাকি প্রতীক্ষার প্রহর। বন্ধুদের নিয়ে কখন হবে আনন্দ উদ্‌যাপন, কখন একসঙ্গে করব হইহুল্লোড়!

পুরান ঢাকার শাঁখারি বাজার থেকে সংগ্রহ করি নাটাই ঘুড়ি সুতাসহ ঘুড়ি ওড়ানোর সব সরঞ্জাম। রাজধানীর গুলিস্তান থেকে নিশ্চিত করি ঢাকা-মৈনট ঘাট-ঢাকার পরিচ্ছন্ন সার্ভিসের একটি দ্রুততম বাস। পরিদর্শনের সময়ই ঠিক করে এসেছিলাম মৈনট ঘাট-চর শালিপুর-মৈনট ঘাটের প্রমোদতরি। আনুষঙ্গিক কেনাকাটার পর্ব পেরিয়ে শুরু হয় অপেক্ষার পালা।

হ্যালির ধূমকেতুর মতো দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর আসে প্রত্যাশার সর্বোচ্চ প্রতীক্ষিত উজ্জ্বল দিন ‘আমাদের আনন্দযাত্রার দিন’ ৯ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। পূর্বনির্ধারিত দুটি ভেন্যুতেই জড়ো হতে থাকেন স্বপ্নের উৎসবে সাক্ষী হওয়া বন্ধুরা। সকাল আটটায় কেরানীগঞ্জের কদমতলী এবং সাড়ে আটটায় কোনাখোলা মোড়ে অপেক্ষমাণ বন্ধুরা হাসি হাসি মুখে উঠে পড়েন ভ্রমণ বাসে।

বন্ধুদের কেউ কেউ হাতে করে নিয়ে আসেন ফুটবল, ক্রিকেট ব্যাট, বল ও স্টাম্প এবং পিঠাপুলির মতো ভালোবাসার থালি। ভ্রমণ বাস যখন ভালোবাসার পদধূলিতে ভরপুর, তখন ছেড়ে গেল আমাদের গাড়ি, যেতে হবে বহুদূর। গাড়িতেই শুরু হলো গান, কৌতুক পরিবেশন ও আড্ডাবাজি। এমন মধুর পরিবেশে সবাই যেন হারিয়ে যেতেও রাজি।

সকালের নাশতায় পরিবেশিত হয় মেড ইন জিনজিরার বিখ্যাত বেকারির প্রসিদ্ধ বানরুটি, গাছের পাকা কলা ও দেশি মুরগির পুষ্টিকর ডিম ও খনিজ পানি। নাশতা খেতে খেতেই রাস্তা ফুরিয়ে গেল অনেকটাই। গানে গানে মুখর আমাদের আনন্দযাত্রা। বন্ধুরা মুঠোফোনে বন্দী করতে থাকেন স্মৃতির খেরোখাতা। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে পৌঁছায় মৈনট ঘাটে।

পদ্মার বুকে বন্ধুদের বল খেলা
ছবি: বন্ধুসভা

আগে থেকেই অপেক্ষমাণ প্রমোদতরি নোঙর ফেলে বসে আছে প্রমত্ত পদ্মার বুকে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বলে। বাসে থাকা প্রয়োজনীয় খাদ্য, বাদ্য ও খেলার সামগ্রী হাতে হাতে কাঁধে কাঁধে বয়ে নিয়ে যেতে থাকি প্রমোদতরিতে। সবাই সবাইকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে উৎসবের মেজাজে। সবকিছু ঠিকঠাক তরিতে তুলে আমরা ভেসে যাই স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর পদ্মা নদীতে।

তরিতে উঠেই সবার হাতে তুলে দেওয়া হয় লাল-সবুজ রঙে রাঙানো দুটি ভিন্ন রঙের প্রথম আলো বন্ধুসভার লোগো অলংকৃত টি-শার্ট। সবাই উৎসবের টি-শার্ট পরতে থাকে আর আমাদের তরি এগিয়ে যেতে থাকে গন্তব্যে, আনন্দের বর্ণনা চলতে থাকে বন্ধুদের মন্তব্যে।

মৈনট ঘাট থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে চর শালিপুরের কাছে একটি নিভৃত পল্লির কাছে তরি ভিড়িয়ে কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতিতে হেঁটে দেখি স্নিগ্ধ কোমল সোঁদা মাটির গন্ধমাখা গ্রামটি। আহা কী মায়া ছড়ানো গ্রাম! মায়ের কোমল মমতার মতো জান্নাতি বাতাস এখানে বয়ে যায়, মন চায় থেকে যাই অনাদিকাল এই মায়াবতী নিভৃত পল্লিতে। ঘুরে ঘুরে দেখি, অনেক বাড়িতে মানুষ গরু ও ঘোড়া লালন–পালন করছেন। ঘোড়ার পিঠে হাতের কোমল পরশ বুলিয়ে অনেকেই আপ্লুত হয়েছেন, অনেকেই বন্দী করেছেন এই দুর্লভ স্মৃতি মুঠোফোনের ক্যামেরায়।

সময় পর্যাপ্ত না থাকায়, খেলাধুলার মতো তেমন মাঠ না পাওয়ায় মায়াময় এই পল্লি ছেড়ে চর শালিপুরের গন্তব্য পরিবর্তন করে আমাদের ক্যাপ্টেন রতন ভাইয়ের পরামর্শে মাঝি তরি ছাড়ে দূরবর্তী কোনো চরের দিকে। ছুটে চলে প্রমোদতরি, ছুটে চলে আমাদের স্বপ্নেরা। হঠাৎ চোখে পড়ে এক বিস্তীর্ণ চর, চর নয় যেন এক টুকরা সেন্ট মার্টিন, চতুর্দিকে তার থেকে থেকে ছেঁড়াদ্বীপ। বন্ধুরা একসঙ্গে গেয়ে ওঠে উল্লাসের গান, জেগে ওঠে আমাদের প্রাণ।

নেমে যাই বিস্তীর্ণ চরে। মেতে উঠি আনন্দ গানে। চতুর্দিকে পদ্মার স্বচ্ছ জল আর নির্মল বাতাস দেখে মনের অজান্তেই গেয়ে উঠি ‘মন চায় উড়ি উড়ি, নাটাই হাতে ওড়াই ঘুড়ি’। যে কথা সেই কাজ, ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব হলো শুরু। ঘুড়ি উড়ছে, সঙ্গে উড়ে দূরে চলে যাচ্ছে মনে জমা যত বেদনার মেঘ। আহা! এভাবেই যদি ঘুড়ির মতো উড়ে বেড়াতে পারতাম নীল আকাশে। মনের যত দুঃখ পুড়িয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে খেলতে নামি ফুটবল, একটু পরপর সোরগোল, গোল!

খেলতে খেলতে ক্লান্ত দেহে ফিরিয়ে আনতে প্রাণ, নদীর বুকে করতে নামি স্নান। এত সুন্দর পানি, এতটা স্বচ্ছ, দূষণমুক্ত কোনো ভাষা নেই যে তা ব্যাখ্যা করব! শুধুই ডুবে ডুবে ভেসে ভেসে সাঁতরাতে সাঁতরাতে বুকের ক্ষতগুলো পদ্মায় ডুবিয়ে তীরে এসে তরিতে উঠে ক্ষুধার যন্ত্রণা লাঘবে মধ্যাহ্নভোজে মেতে উঠি সবাই। নবাবগঞ্জের নবাব কাচ্ছিঘর থেকে আনা মোরগের মাংস আর মুরগির ডিমের সঙ্গে চিনিগুঁড়া চালের মোরগ–পোলাও এতটাই কাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে, বিস্তীর্ণ চরে বসে তা না খেলে আপনি কখনোই উপলব্ধি করতে পারবেন না।

ফেরার পথে
ছবি: বন্ধুসভা

খেয়েদেয়ে হৃষ্টপুষ্ট শরীর ও মনে যোগ দিই বল পাসিং ও হাঁড়িভাঙা উৎসবে। একে একে বীরদর্পে বাঁধা চোখে স্বপ্ন নিয়ে, হাতে লাঠি নিয়ে বন্ধুরা এগিয়ে যেতে থাকেন হাঁড়ির দিকে, কারও আঘাতে হাঁড়ি ভাঙে, বিচ্ছিন্ন আঘাতে কারও স্বপ্ন ভাঙে। উপস্থিত অন্যদের তাতে কম পড়ে না উল্লাসে, হাঁড়ি ভাঙলেও হইচই, ভাঙতে না পারলেও হইচই। অতঃপর শুরু হয় বল পাসিং খেলা। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হাতে হাত বাড়িয়ে চলতে থাকে বল পাসিং খেলা, জমে ওঠে আনন্দ মেলা।

উৎসবে উন্মাতাল বন্ধুদের হাঁকডাক থামে ক্যাপ্টেন রতন ভাইয়ের ডাকে, ফিরতে হবে, বেরসিক সময় ঘনিয়ে যাওয়ার আর সময় পেল না! নিস্তব্ধ চরাচরকে আবারও স্তব্ধ করে ছেড়ে যেতে কী যে মায়া হচ্ছিল, সে কথা বর্ণাতীত। তবু যেতে হবে নীড়ে, তাই তরিতে উঠে বেদনাকে প্রশ্রয় না দিয়ে বন্ধুরা একে একে গেয়ে ওঠেন উল্লাসের গান।

গানে গানে প্রমত্ত পদ্মা পেরিয়ে আবারও ফিরে এলাম মৈনট ঘাটে। মৈনট ঘাট থেকে সূর্যাস্ত উপভোগ করার জন্য ৩০ মিনিটের বিরতি দেওয়া হলে সবাই নিজেদের মতো ছবি তোলে, টুকিটাকি কেনাকাটা করে, চা-চক্র আড্ডার পর সবাই উঠে বসেন গাড়িতে। গাড়িতে বাড়ি ফিরে আসার আগে যে আরও আনন্দ অপেক্ষা করছিল, তা কল্পনাতীত।

বাস ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আয়োজন হয় কুইজ পর্বের, একটার পর একটা প্রশ্ন একজনের পর একজন সঠিক উত্তর দিয়ে প্রায় ২৫ জন বন্ধু জিতে নেন মহা মূল্যবান উপহার বই। একই সঙ্গে খেলাধুলায় বিজয়ীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় নান্দনিক সব উপহার।

এরই মধ্যে বন্ধু সাজ্জাত-শানু পরিবারের সৌজন্যে ভাবির হাতে বানানো নকশি পিঠা ও তেলপোয়া পিঠার পাশাপাশি পরিবেশন করা হয় কেরানীগঞ্জের বিখ্যাত বেকারির প্রসিদ্ধ কেক। তারপর আবারও গান, আরও বেশি ফান, মুগ্ধ করতে থাকে বন্ধুদের কান। যতই ফিরে যাওয়ার মুহূর্ত ঘনিয়ে আসছে, ততই মন ভারী হয়ে উঠছিল।

প্রতিবছরের মতো এবারও আমাদের আয়োজনটি ছিল পরিবারের সদস্যদের যুক্ত করে। উদ্দেশ্য ছিল আমরা কী করি, কেন করি তাঁদেরকেও রাখি জানিয়ে। উৎসবটি সবচেয়ে বেশি সার্থক হয়েছে পরিবারের ছোট শিশুদের আনন্দে। তাদের চোখে আগামী দিনের আলো থেকে আমরা খুঁজে পেতে চাই ভালোর পথের যাত্রা। শিশুদের প্রতিই আমাদের সব প্রত্যাশা, নতুন আলোর দিন। সুখের ঝরনাধারার মতোই শেষ হলো এবারের মৈনট ঘাট পেরিয়ে, পদ্মার ঢেউ এড়িয়ে আমাদের উৎসবমুখর দিন।

সভাপতি, কেরানীগঞ্জ বন্ধুসভা