শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘গৃহদাহ’ নিয়ে পাঠচক্র

মুরারিচাঁদ কলেজ বন্ধুসভার পাঠচক্র শেষে বইয়ের সুন্দর রিভিউ উপস্থাপন করায় বন্ধু চৌধুরী নাফিসাকে পুরস্কার দেওয়া হয়ছবি: বন্ধুসভা

‘গৃহদাহ’ শরৎচন্দ্র চট্রোপাধ্যায়ের এক অমর সৃষ্টি। এ উপন্যাস প্রণয় সংকটে ভুগতে থাকা তিনজন নর-নারীর ত্রিভুজ প্রেমের আখ্যান। ‘গৃহদাহ’ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র বাঙালির আত্মিক বৈশিষ্ট্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ব্যক্তিমানসের পারস্পরিক সম্পর্ক, তাদের প্রেম-পরিণয়, বিশ্বাসকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সমাজ-সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ন্যায়-নীতি যে কীভাবে সম্পূর্ণরূপে সমাজের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, তা এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য।

প্রধান চরিত্র অচলা। তাকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণমান দুটি চরিত্র মহিম ও সুরেশ। পুরো কাহিনি বর্ণিত হয়েছে অচলার মনোজাগতিক সিদ্ধান্তহীনতাকে কেন্দ্র করে। অচলার চিত্তজাগতিক দোলাচলবৃত্তি ও সিদ্ধান্তহীনতা নষ্ট করেছে তার মনোভারসাম্য, দগ্ধ করেছে তার অন্তরালয়। অচলা আসলে কাকে চায়? মহিম, নাকি সুরেশ? এই অন্তর্দ্বন্দ্বকেন্দ্রিক অচলার চারিত্রিক সিদ্ধান্তহীনতার সমাপ্তি পাঠক কখনোই খুঁজে পাবেন না। মাঝখানে পাবেন অচলা চরিত্রের প্রতি দগ্ধ-বিদগ্ধ ক্ষোভ-হতাশা আর ভারসাম্যহীনতা। লেখক খুবই সূক্ষ্মভাবে অচলার চরিত্রকে তুলে ধরেছেন।

অচলা ছোটবেলা থেকে তার বাবার দেওয়া শিক্ষায় শিক্ষিত। তার সত্তা, চিত্ত, মন—সবকিছু দোলাচলে আন্দোলিত। তাই প্রথম দিকে সুরেশের অসংযত আবেগদীপ্ত ব্যবহার বিরক্ত করেনি এবং তার প্রতি আমন্ত্রণও ছিল না, প্রত্যাখ্যানও না।

এ ছাড়া পিতৃগৃহে মানসিক অসম্পূর্ণতায় লালিত, কেদারবাবুর সংসার অসংগঠিত ছিল। তিনি নিজে ছিলেন অস্থির চিত্তের, টাকাপয়সা সংক্রান্ত ব্যাপারে মন ভারমুক্ত হলে বায়োস্কোপও দেখতে যান। পেটি বর্জোয়া প্যাটার্নে তার চিন্তাভাবনা আচার–আচরণ বিন্যস্ত।

অচলা বিয়ের পর মহিমের সঙ্গে গ্রামে এসে মৃণাল ও মহিমের সম্পর্কে কদর্য সন্দেহ, সর্বোপরি মহিমের নিঃস্নেহ কঠোর কর্তব্যপরায়ণতা তার মনেপ্রাণে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মহিম সব সময়ই ছিল নিরুত্তাপ আবেগহীন। অচলা মহিমকে একান্তভাবে পেয়েও তার প্রেমোচ্ছল হৃদয়খানি মেলে দিতে পারেনি। সঙ্গে সুরেশের আগমন এক সর্বব্যাপক অগ্নিশিখা তার লেলিহান জিহ্বা বিস্তার করে! আর ধীরে ধীরে জীবন এগোতে থাকে গল্পের দিকে, মোহের দিকে, অন্ধত্বের দিকে।

এ উপন্যাসে শরৎচন্দ্র সমসাময়িক সামাজিক জাতির আত্মিক বৈশিষ্ট্য, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ব্যক্তিমানসের পারস্পরিক সম্পর্ক, তাদের প্রেম-পরিণয় বিশ্বাস ইত্যাদিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর সেখানে ত্রয় চরিত্র হয় সুরেশ-অচলা-মহিম। নিজের অজান্তে অচলা সুরেশের প্রবৃত্তিকে ইন্ধন জুগিয়েছে। হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠের আত্মক্ষয়ী আর্তনাদ অচলাকে দ্বিধান্বিত সত্তায় এনে সময়কে গহ্বরে টেনে নেয়। এভাবে, ক্রমাগত সুরেশ ও মহিমের গ্রাস করা জীবনের প্রজ্বলন্তশিখায় অচলার জীবন-হৃদয় দ্বিধান্বিত সত্তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অগ্নিদগ্ধ হয়ে পুড়েছে আমৃত্যু পর্যন্ত।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘গৃহদাহ’ বইটি নিয়ে ২৮ এপ্রিল পাঠচক্রের আসর করেছে মুরারিচাঁদ কলেজ বন্ধুসভা। সঞ্চালনা করেন পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক সামিয়া আক্তার এবং সভাপতি মেহেদী হাসান। উপস্থিত ছিলেন সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহেল আহমদ, বন্ধু অমল দাস, সৈয়দা তামান্না ও অনুপ দাস।

উপস্থিত বন্ধুরা অত্যন্ত সুন্দরভাবে নিজ নিজ মনোভাব এবং মন্তব্য প্রকাশ করেন, রিভিউ দেন। সবচেয়ে সুন্দর রিভিউ উপস্থাপন করে পুরস্কার জিতেছেন বন্ধু চৌধুরী নাফিসা।

পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক, মুরারিচাঁদ কলেজ বন্ধুসভা