অনুষ্ঠানের উপস্থাপক একে একে সব মাকে মঞ্চে বসার জন্য ডাকছিলেন। মায়েরা মঞ্চে উঠে পেছনের চেয়ারগুলোতে বসছিলেন। একজন মা–ও সামনের চেয়ারে বসছেন না। বোঝা গেল কোনো দিন কেউ তাঁদের মঞ্চের অতিথির চেয়ারে বসার জন্য ডাকেননি। অবশেষে তাঁদের জোর করে সামনের চেয়ারে বসানো হলো। এরপরে নিজ নিজ সন্তান মাকে ফুল দিয়ে বরণ করতে লাগলেন। একজন মা নিজের মেয়ের হাত থেকে ফুল নেওয়ার সময় মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তখন মিলনায়তন ভর্তি সব দর্শক কাঁদছেন।
১৪ মে বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সেমিনার কক্ষে এই ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে রাজশাহী বন্ধুসভা। ফুল দিয়ে মায়েদের বরণ শেষে মঞ্চে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভার বন্ধু আনোয়ার হোসেন। তিনি খালি গলায় গাইলেন ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক, আমি তোমায় ছাড়ব না মা, আমি তোমার চরণ করব শরণ আর কারও ধার ধারব না মা...’ দরদি কণ্ঠে গাওয়া আনোয়ারের এই গানে আরেক দফা সবার চোখ ভিজে উঠল।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পুঠিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ, রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমির সংস্কৃতিবিষয়ক কর্মকর্তা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা আসাদ সরকার, রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক আলমাস উদ্দিন মল্লিক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কর্মসূচির সংগঠক দুলাল চক্রবর্তী, রাজশাহী বন্ধুসভার সভাপতি সাব্বির খানসহ আরও অনেকে।
মঞ্চে উপবিষ্ট মা শামীমা বেগমকে প্রথমে ফুল দিয়ে বরণ করেন তাঁর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ছেলে শাকিল হোসেন। তিনি তাঁর প্রতিবন্ধী সন্তানকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য ১০ বছর থেকে বাড়ি ছাড়া হয়ে আছেন। তিনি নিজে দর্জির কাজ করে ছেলেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করিয়েছেন। এরপর একে একে মায়েদের ফুল দিয়ে বরণ করা হয়। মা আয়েশা সিদ্দিকাকে ফুল দেন তাঁর কন্যা সাদিয়া তাসনীম, মা শামীমা সুলতানাকে বরণ করেন কন্যা ফারহানা আফরিন, লতিফা ইসলামকে মেয়ে বিভা, মা মৌসুমীকে বরণ করেন মেয়ে ফিমা, শাহীনা ইসলামকে বরণ করেন মেয়ে ইসরাত জাহান, মা তানিয়া ইসলামকে বরণ করেন মেয়ে অহনা ও ছেলে অর্নব, দিলরুবা বেগমকে স্নেহ, শাহিদা সুলতানাকে সুমাইয়া নিশাত, বিভা সাহাকে রিদিতা কুন্ডু, হুমাইয়াকে মার্জিয়া, বিলকিস বানুকে রাইনা, শাহানাজ পারভীনকে জয়া, আফরোজা বেগমকে ছেলে উৎসব, রেজিনা খাতুনকে ফুল দেওয়ার সময় তাঁর ছেলে বন্ধুসভার বন্ধু ইসতিয়াক ফারুকী মায়েদের জন্য নাশতা আনতে বাইরে ছিলেন। তাঁর পরিবর্তে সভাপতি সাব্বির খান এই মাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন।
ব্যতিক্রমী এই আয়োজনের পটভূমি বর্ণনা করে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ। ইউএনও নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ মঞ্চের নিচে বসেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আজকের দিনে মঞ্চ মায়েদের জন্য।’ তিনি মঞ্চে বসবেন না। তাঁর বক্তব্যে ধর্মীয় ও সামাজিক উদাহরণ দিয়ে একজন সন্তানের কাছে মায়ের কী মূল্য, তা পরিষ্কার করেন। তিনি আরও বলেন, ‘এখনকার কোনো কোনো মা সন্তানদের যে টিফিন দেন, তা অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে শেয়ার না করার জন্য শাসিয়ে দেন। তার সুন্দর পেনসিলটা যেন বন্ধুকে ব্যবহার করতে না দেয়, এ জন্য কড়াভাবে বারণ করে দেন। এতে সন্তান আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপরতার শিক্ষা পায়। বড় হয়ে সেই শিক্ষা থেকে সে মা–বাবার সঙ্গেও একই আচরণ করে।’
চলচ্চিত্র নির্মাতা আসাদ সরকার তাঁর জীবনের বড় দুটি দুর্ঘটনার কথা বলেন। ঠিক দুর্ঘটনা ঘটার সময় তাঁর ফোনে মায়ের একের পর এক রিং আসতে থাকে। পরে তিনি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন ওই সময় ফোন দিয়েছিলেন। মা বলেছিলেন, ‘বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। এ জন্য ফোন দিয়েছিলাম।’ পাঁচজন ছেলে থাকতে তার কাছে কেন ফোন দিয়েছিলেন। মা বলেছেন, ‘তা জানি না।’ আসাদ সরকার বলেন, ‘মা জানি না বললেও এটা শুধু মায়ের পক্ষেই সম্ভব। এই অনুষ্ঠানে আমার মা উপস্থিত নেই; কিন্তু আমাদের মা আছেন সব মাকে শ্রদ্ধা।’
বন্ধুসভার বন্ধু মাসুদ রানার মা মারা গেছেন। তিনি বললেন, ‘সন্তানদের মানুষ করার জন্য তাঁর মা গোপনে অনেক টাকা ঋণ করেছিলেন। হাসিমুখে তিনি সেই ঋণ শোধ করেছিলেন। আরও ঋণ করেও যদি মা বেঁচে থাকতেন, তবু তিনি সেই ঋণ শোধ করতেই আনন্দ পেতেন।’
মা বিভা সাহা বললেন, তাঁর বিয়ের সময় মা অনেক কেঁদেছিলেন। সম্প্রতি তিনি তাঁর সাত বছরের মেয়ে রিদিতা কুন্ডুকে দার্জিলিং পড়তে রেখে আসেন। মেয়েকে ছেড়ে থাকতে না পেরে এক মাস পর ৯০ হাজার টাকার টিউশন ফি বাতিল করে মেয়েকে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। এবার তিনি বুঝতে পেরেছেন। তার বিয়ের সময় মা কেন এত কেঁদেছিলেন।
সবচেয়ে হৃদয়বিদারক বর্ণনা ছিল দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শাকিল হোসেনের মা শামীমা বেগমের বক্তব্যে। তাঁর কথায় কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। দীর্ঘ বক্তব্যের মধ্যে একটি কথা তিনি জোর দিয়ে বলেন, রাগ করেও যেন কোনো মা সন্তানকে না মারেন আর সন্তানও যেন মাকে ভুল না বোঝেন। আর যে মা মেয়ের হাত থেকে ফুল নেওয়ার সময় কেঁদেছিলেন, আবেগে শেষ পর্যন্ত তিনি আর কথাই বলতে পারেননি।