‘একটি বই জীবন বদলে দিতে পারে’

রাজশাহী বন্ধুসভার উদ্যোগে পলান সরকার স্মরণসভা
ছবি: বন্ধুসভা

‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দান হলো জ্ঞানদান’—এই মহান দর্শনকে হৃদয়ে ধারণ করে জীবন কাটিয়েছেন পলান সরকার। নিজের টাকায় বই কিনে মানুষকে পড়তে উৎসাহিত করা, বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তোলা—এসব কীর্তি তাঁকে বাংলার মাটিতে এক অনন্য বইপ্রেমী হিসেবে পরিচিত করে তুলেছে। তাঁর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণসভা ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে রাজশাহী বন্ধুসভা। ১ মার্চ বিকেলে রাজশাহী প্রথম আলো অফিসে এটি অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় বন্ধুরা পলান সরকারের জীবন, আদর্শ এবং শিক্ষার প্রসারে তাঁর অসামান্য অবদান নিয়ে আলোচনা করেন। সঞ্চালনা করেন পাঠাগার ও পাঠচক্র সম্পাদক ঔড়ব আজাদ।

সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ‘পলান সরকার আমাদের সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার যে কাজ করেছেন, তা অতুলনীয়। তিনি কখনো কোনো স্বীকৃতির আশায় এ কাজ করেননি, করেছেন শুধু মানুষের মঙ্গলচিন্তা থেকে। বই ছিল তাঁর অস্ত্র, আর শিক্ষার আলো ছড়ানো ছিল তাঁর যুদ্ধ। একজন মানুষ কতটা নিঃস্বার্থ হলে নিজের কষ্টার্জিত অর্থ খরচ করে হাজারো মানুষের মধ্যে বই বিলি করতে পারেন! শিক্ষা শুধু নিজের জন্য নয়, অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার। আজ যখন আমরা ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছি, তখনো তিনি প্রমাণ করে গেছেন যে বইয়ের চেয়ে বড় কোনো বন্ধু নেই। তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করলে আমরা সত্যিকারের শিক্ষিত জাতিতে পরিণত হতে পারব।’

প্রথম আলো রাজশাহীর নিজস্ব প্রতিবেদক আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ বলেন, ‘আমরা যখন প্রথমবার তাঁর কথা জানতে পারি, তখন সত্যিই বিস্মিত হয়েছিলাম—একজন মানুষ, যিনি নিজের টাকায় বই কিনে দরিদ্র মানুষদের পড়তে দেন এবং তা ফেরত নিয়ে নতুন বই দেন! ২০০৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে তাঁকে নিয়ে “বিনি পয়সায় বই বিলাই” নামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে সারা দেশে তিনি পরিচিতি পান। আজকের দিনে যখন অনেকেই বই পড়তে আগ্রহী নয়, তখন তিনি বই পড়াকে ভালোবাসার কাজ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।’

এভাবেই গ্রামে গ্রামে গিয়ে বই বিলান পলান সরকার

আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ বলেন বলেন, ‘এই মানুষটিকে সম্মান জানিয়ে ২০০৯ সালে জেলা পরিষদ তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ২০১১ সালে তিনি পেয়েছেন একুশে পদক, যা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মানগুলোর মধ্যে একটি। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এত বড় সম্মান পাওয়ার পরও তাঁর জীবনে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি। তিনি আগের মতোই হেঁটে হেঁটে বই বিতরণ করে গেছেন, মানুষের কাছে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দিয়েছেন।’

দপ্তর সম্পাদক সুশীল চন্দ্র পাল বলেন, ‘পলান সরকার দেখিয়ে গেছেন, সমাজ বদলাতে হলে বড় কোনো পদ বা ক্ষমতা দরকার নেই, দরকার শুধু ইচ্ছাশক্তি। আজ তাঁকে স্মরণ করা মানে শুধু শ্রদ্ধা জানানো নয়, বরং তাঁর দেখানো পথে হাঁটার প্রতিজ্ঞা করা; যাতে বইয়ের আলো আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়। আমরা রাজশাহী বন্ধুসভার পক্ষ থেকে বই পড়ার আন্দোলনকে আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করছি। বন্ধুসভার মাধ্যমে বই পড়ার প্রচার চালিয়ে যাব, গ্রামেগঞ্জে পাঠাগার তৈরির উদ্যোগ নেব এবং তরুণদের বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলব।’

সাংস্কৃতিক সম্পাদক নাহিদ হাসান বলেন, ‘পলান সরকার আমাদের সমাজের জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাঁর জীবন ছিল সংগ্রামের, কিন্তু সেই সংগ্রাম কেবল নিজের জন্য নয়, অন্যদের জন্য। তাই তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন মানুষকে শিক্ষিত করার জন্য। আজ আমরা দেখি, সমাজে অনেকে টাকার জন্য, প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে; কিন্তু পলান সরকার কিছুই চাননি। তিনি শুধু চেয়েছিলেন, গ্রামের সাধারণ মানুষ বই পড়ুক, শিক্ষিত হোক। তিনি জানতেন—একটি বই জীবন বদলে দিতে পারে। আমরা যদি সত্যিই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে চাই, তাহলে আমাদেরও বই পড়তে হবে, অন্যদের বই পড়তে উৎসাহিত করতে হবে। তাহলেই তাঁর স্বপ্ন সত্যি হবে।’

ম্যাগাজিন সম্পাদক দেবযানী বিশ্বাস বলেন, ‘পলান সরকার শুধু একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি আন্দোলন, একটি অনুপ্রেরণা। তাঁর জীবন দেখলে বোঝা যায়, মানুষ চাইলে যেকোনো বয়সে, যেকোনো পরিস্থিতিতে সমাজের জন্য কিছু করতে পারে। তাঁর দেখানো পথ আমাদের তরুণদের জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে থাকবে। আজ আমরা যখন তাঁকে স্মরণ করছি, তখন শুধু তাঁর নাম উচ্চারণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং আমাদের উচিত তাঁর আদর্শকে বাস্তবে রূপ দেওয়া। আমরা যদি সত্যিই তাঁকে সম্মান জানাতে চাই, তাহলে আমাদের জীবনে বই পড়াকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং অন্যদের বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তাহলেই তাঁর স্মৃতি চিরকাল বেঁচে থাকবে।’

বই নিয়ে গ্রামের পথে পলান সরকার
ফাইল ছবি

কার্যনির্বাহী সদস্য আসিফ ইমতিয়াজ বলেন, ‘পলান সরকার ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি নিজে উচ্চশিক্ষিত না হয়েও বুঝেছিলেন, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়াই সমাজের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন। আমরা তরুণেরা অনেক সময় নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে গিয়ে সমাজের জন্য কিছু করার কথা ভুলে যাই। কিন্তু পলান সরকার দেখিয়ে গেছেন, সমাজের জন্য কিছু করতে হলে বিশাল কিছু হতে হয় না, শুধু একটা ভালো চিন্তা আর নিষ্ঠা থাকলেই হয়।’

সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন সহসভাপতি উৎসব সরকার, পরওয়ার হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদিকা সোনালীসহ অন্য বন্ধুরা।

সহসভাপতি, রাজশাহী বন্ধুসভা