বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে ভুল চিকিৎসায় দৃষ্টিশক্তি হারান এস এম সোহেল। তবু থেমে থাকেননি তিনি। প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে একটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শুরু করেন শিক্ষকতা। নিজে দৃষ্টিহীন হলেও ১৬ বছর ধরে নিরলসভাবে শিক্ষার আলো বিতরণ করে যাচ্ছেন। প্রথম আলোর ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি ভালো কাজের অংশ হিসেবে তাঁকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বন্ধুসভা। এ সময় তিনি বন্ধুদের শোনান প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সফল হওয়ার গল্প।
বর্তমানে জেলা শহরের সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত সোহেল। ১৯৭৯ সালে জন্মগ্রহণ করা সোহেল শহরের নিউ মৌড়াইল এলাকার মিজানুল হকের ছেলে। তিনি ব্রেইল পদ্ধতিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ঢাকার মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি সিলেটের জকিগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ২০১০ সালের ৪ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রাচীন বিদ্যাপীঠ অন্নদা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে বদলি হন। পরে সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, সরাইলের অন্নদা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও পুনরায় সাবেরা সোবহান সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
এস এম সোহেল বলেন, ‘দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বসন্ত রোগে আক্রান্ত হই। প্রায় এক মাস অজ্ঞান ছিলাম। যখন সুস্থ হলাম, তখন চোখ খুলতে সমস্যা হতো, চোখ দিয়ে পানি পড়ত। জেলার এক চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় ওষুধ খেয়ে দুই চোখের কোনায় পর্দা জমে পানি পড়া বন্ধ হয়ে যায়। পানি উৎপাদনের উৎস নষ্ট হয়ে যায়।’
সোহেল বলেন, ‘এক চাচার পরামর্শে সেলিম হোসেন স্যারের কাছে ১৯৯২ সালে ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা শুরু করি। ১৯৯৩ সালে ছয় মাসে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির পড়া শেষ করি। ১৯৯৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ঢাকার মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাস করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম বছর সমাজকল্যাণ এবং পরের বছর পুনরায় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করি। সিলেটের জকিগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু। সেখানকার প্রধান শিক্ষক গোলজার আহমেদ খান অনেক সহায়তা করেছেন। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি নেই বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুই বিদ্যালয়ের প্রধান আমাকে যোগদান করতে দেননি। আমার যোগ্যতার চেয়ে দৃষ্টিশক্তির এবং আমি কীভাবে পড়াব, এটি তাঁদের চিন্তার প্রধান কারণ ছিল। আমার জন্য সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাজ। যোগদানের পর বর্তমান কর্মস্থলে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়ে কিছু সহকর্মী নানা কথা বলতেন। ১৬ বছরের শিক্ষকতার জীবনে এসব মনে দাগ কেটে আছে। ২০০৫ সালে পিএসসি বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয়নি।’
সোহেল আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আমার ক্লাস উপভোগ করে। আমি সব শিক্ষার্থীকে নামে চিনি। সব বই রেকর্ড করে এবং কম্পিউটারের সহায়তায় মস্তিষ্কে নিয়েছি। শ্রেণিকক্ষে রিডিং পড়াকে প্রাধান্য দিই। ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী ইংরেজি পড়তে পারে না। শিক্ষার্থীদের দিয়ে বোর্ডের কাজ করাই। এতে পাঠ আলোচনাও হয় এবং সমস্যাও নির্ধারণ হয়।’
এস এম সোহেল বলেন, ‘প্রথমদিকে জীবনে স্থবিরতা নেমে আসে। পাড়া-প্রতিবেশী ও পরিবার সেখান থেকে আমাকে বের করে নিয়ে আসে। পরে যা হয়েছে তার সবই আমার জীবনের সুখের গল্প। প্রয়াত মা আমিরুন নেছা হক আমাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছেন। আমি অন্যের ওপর নির্ভরশীল থাকব, তা মা মানতেই পারতেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন চাচা শামীমুল হকের কাছ থেকেও পেয়েছি।’
‘দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর বুঝতে পারলাম মানুষ আরও প্রতিবন্ধকতা নিয়ে পড়াশোনা করে। স্বপ্ন দেখানোর ও স্বপ্ন তৈরি করার কেউ না কেউ থাকতে হবে। নিজের মধ্যে স্বপ্ন দেখার একটা আগ্রহও থাকতে হবে। ইচ্ছাশক্তি তীব্র না হলে কোনো কাজে সফলতা আসে না’, যোগ করেন সোহেল।
বন্ধুদের উদ্দেশে এই শিক্ষক বলেন, ‘সমাজে একটা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি আনতে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে সমাজে কিছু করা যাবে না। প্রতিবন্ধীদের অধিকার সংরক্ষণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম আলো আগে উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ, প্রথম আলো প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের সাক্ষাৎকার ছাপে প্রথম আলো। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে গণমাধ্যমের একটা বড় ভূমিকা আছে, যা প্রথম আলো সুন্দরভাবে করে যাচ্ছে।’
এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শাহাদৎ হোসেন, বন্ধুসভার সভাপতি শাজাহান মিয়া, সহসভাপতি মাইনুদ্দিন রুবেল, সাধারণ সম্পাদক সাদ হোসেন, অর্থ সম্পাদক ফাহমিদা আক্তারসহ অন্য বন্ধুরা।