নোটিশ

অলংকরণ: তুলি
পুরুষ মানুষ যখনই অগোছালো থাকে, তখনই প্রিয় মানুষটির দেখা মিলবে। প্রকৃতি পুরুষকে বিব্রত করতেই হয়তো এমন কাণ্ড ঘটায়।

সেমিস্টারের শেষ ক্লাস। সামনে ফাইনাল পরীক্ষা। কোথাও না বসে সোজা বাসার দিকে রওনা দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাসার দূরত্ব অল্প। হেঁটে মিনিট পনেরো আর বাসে যেতে পাঁচ মিনিট। হেঁটে যাওয়াটাই স্বস্তির। খালের পাড়ে প্রশস্ত রাস্তা, দুই পাশে ৫০ বছরের জৌলুশ গাছ, পাখির কলতান ও গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের উঁকি দেওয়া—দারুণ প্রকৃতি। এই সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাখির বাসা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, আর মাইকেল মধুসূদন দত্ত নদীর পাড়ে বসে কবিতা লিখতেন। কবিরা প্রকৃতিপ্রেমী। তাঁদের জীবনে প্রেম আসে বারবার। হোক সেটা প্রকৃতি কিংবা নারীর প্রতি। ফরসা মেয়ের মধ্যেও যে সৌন্দর্য রয়েছে, শ্যামা মেয়েরও একই সৌন্দর্য। রঙে কখনো সৌন্দর্যের বিচার হয় না। সৌন্দর্যের বিচার হয় মানুষের রুচিতে।

বুড়ো আমগাছটার পাশ দিয়ে যেতেই ডান কাঁধে কী যেন পড়ল। তাকিয়ে দেখি, কালো কাকের সাদা বিষ্ঠা। অবাক হলাম না, পূর্বের অভিজ্ঞতা আছে। দুই ফোঁটা পানি নিয়ে মুছলেই উঠে যাবে। রাস্তার মোড়ে ফরিদ মামা ঝালমুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে। এই ঝালমুড়ির বেশ সুনাম আছে। শ্রাবণীর বেশ পছন্দ।

শ্রাবণী আমার চোখে প্রকৃতির সব থেকে সুন্দর অংশ। প্রথম দেখেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীনবরণে। শ্যামাবরণ মেয়েটি নীল রঙের শাড়িতে নিজেকে আবৃত করেছিল। ঘন কেশের খোঁপা শ্বেতরজনীগন্ধায় মোড়া। কপালের লাল টিপ যেন ডুবন্ত সূর্যের প্রতিফলন। ঠোঁটের কোনার ভাঁজটা যেন মহিষের বাঁকানো সিং। সেদিন প্রকৃতির এই গোধূলি রূপ হৃদয়ে বসন্ত এনেছিল।

সবাই বলে, আমি বেশ চাপা স্বভাবের। কিন্তু এবার আর হৃদয়ে ওঠা ঝড় লুকাতে পারলাম না। বাসায় ফিরে রুমমেট জহিরকে সব জানালাম। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মেয়েটিকে পেলাম না। কয়েক দিন কেটে যায়। চিন্তায় পড়ে গেলাম। এমন অস্থিরতা আগে কখনো হয়নি। নামহীন মেয়েটি কোথায় হারিয়ে গেল? নাকি সে স্বপ্ন ছিল!

সকাল আটটায় ক্লাস। একদিন ৭টা ৩০-এ ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে পড়লাম। চুল-দাড়ি অগোছালো, পুরোনো এক জোড়া জুতা, সঙ্গে জহির। ক্লাসে ঢোকার আগে হঠাৎ মেয়েটির সঙ্গে দেখা। পুরুষ মানুষ যখনই অগোছালো থাকে, তখনই প্রিয় মানুষটির দেখা মিলবে। প্রকৃতি পুরুষকে বিব্রত করতেই হয়তো এমন কাণ্ড ঘটায়। জহিরকে বললাম, এ-ই সে। মেয়েটিকে দেখে জহির হেসে ওঠে। জানায়, সে চেনে। নাম শ্রাবণী। ওর ছোট বোনের বান্ধবী।
শ্রাবণী স্থানীয়। বাবা ব্যবসায়ী, এলাকায় বেশ সুনাম আছে। সে জহিরকে বড় ভাই হিসেবে দেখে। জহির বলল, সেদিন তোকে বললাম আমার এক ছোট বোন অসুস্থ। তাকে দেখতে যাচ্ছি, তুইও চল। তুই গেলি না। এ-ই সে মেয়ে। মাথা কিছুটা নিচু হয়ে গেল। লজ্জায় নয়, আফসোসে।

জহিরকে দেখে শ্রাবণী এগিয়ে আসে। সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া কেমন আছেন?’ সে-ও আলহামদুলিল্লাহ বলে বলল, ‘তোমার কী অবস্থা?’ ‘জি ভাইয়া, আলহামদুলিল্লাহ। একদম সুস্থ।’ এরপরই আমাকে বন্ধু বলে পরিচয় করিয়ে দিল। এরই মধ্যে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আজ আসি বলে বিদায় নিল শ্রাবণী।
আমি আর ক্লাসে গেলাম না। জহিরকে নিয়ে বাইরের সিঁড়িতে বসে চা খেতে লাগলাম। শরীর এখনো কাঁপছে।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষ বৃহস্পতিবার। আতিক স্যারের ক্লাস। মিস দেওয়া যাবে না। বাইরে চা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। কানে আওয়াজ এল, ‘মামা এক কাপ চা দিয়েন’। কণ্ঠটা চেনা। তাকিয়ে দেখি, আমার এক পশলা বৃষ্টি। চায়ের সঙ্গে পত্রিকা হাতে নিয়ে পড়ছে। উত্তরের বাতাসে চুলগুলো মুখের সামনে দোল খাচ্ছে। আজ সে চশমা পরেছে। চশমা পড়লে মেয়েদের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমিও উচ্চ স্বরে দোকানিকে বললাম চা দিতে। কিন্তু হতাশ হতে হলো। শ্রাবণী তাকাল না। সব জড়তা দূরে ঠেলে নিজেই এগিয়ে গেলাম,
- ক্লাস নাই?
- আসসালামুআলাইকুম ভাইয়া। ক্লাস আছে, কিন্তু কেউ আসেনি বলে যেতে ইচ্ছা করছে না। আপনার?
- ক্লাস শেষ করে চা নিয়ে বসছি।
- ওহ আচ্ছা। ভাইয়া (জহির) কোথায়?
- সে আজ আসেনি। তোমার কী অবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় কেমন লাগছে?
- অনেক ভালো।
এভাবেই ধীরে ধীরে শ্রাবণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তবে মনের কথাটি আর বলা হয়ে ওঠে না।

একদিন ফরিদ মামার ঝালমুড়ি খেতে খেতে হাঁটছিলাম। একটু সামনে যেতেই শ্রাবণীর সঙ্গে দেখা। আজ সে সাদা শাড়ি পরেছে। ঝালমুড়ি তার হাতে দিয়ে পাশাপাশি হাঁটছি। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নেমে এল। মেঘহীন আকাশ থেকে নোটিশ ছাড়া বৃষ্টি ঝরাটা বিরক্তির হলেও আজ ভালোই লাগছে। প্রিয় মানুষের সঙ্গে বৃষ্টিবিলাসের স্বপ্ন যার নেই, সে কখনোই প্রেমিক হতে পারে না। শ্রাবণী অনেক গল্প করছে, আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছি। বৃষ্টির ফোঁটা পানিতে পড়লে যেমন শব্দ হয়, তার সুরও তেমন। এ শব্দ শুনলে কখনোই ক্লান্তি আসবে না। মাঝেমধ্যে তার দিকে তাকাচ্ছি। বৃষ্টিভেজা সাদা শাড়িতে মোড়ানো শরীর। রক্তিম ঠোঁটে উজ্জ্বল জলের ফোঁটা। চুল বেয়ে ঝরছে বারিধারা। আর পায়ের আলতা আলপনা আঁকছে রাস্তায়। ইচ্ছা করছে সাদা-কালো হৃদয়টাকে রাস্তায় বিছিয়ে দিতে, যেন তার আলপনায় রঙিন হয়ে ওঠে।

চোখ পড়ল সদ্য ফোটা শুভ্র কচুরি ফুলে। খাল থেকে ফুলটি এনে গেঁথে দিলাম তার খোঁপায়। হয়তো এটুকুই বাকি ছিল। সুন্দর হতে আর কী কী লাগে, জানা নেই। সৌন্দর্যের শেষটা আমি যে তার মাঝেই দেখে ফেলেছি। শ্রাবণী বলল, ‘অবশেষে সাহসটা হলো! আমি সব জানতাম। জহির ভাইয়া আমাকে বলেছে। তাই এমন একটি দিনের অপেক্ষায় ছিলাম।’

মুহূর্তেই মনে হলো, আমি ঠিক শুনছি তো! পৃথিবী যেন জয় করে ফেললাম। স্বপ্ন তার পূর্ণতা পেল আর শেষ হলো অপেক্ষার প্রহর। এই উচ্ছ্বাসের মধ্যে হঠাৎ জহিরের ধাক্কা। ‘কী রে, আজ শ্রাবণীদের বাসায় যাসনি কেন? আজ তো ওর মৃত্যুবার্ষিকী। কথাটি শুনেই ঘোর কেটে গেল। বৃষ্টিও নোটিশ ছাড়াই বিদায় নিল। যেমন এক বছর আগে বিদায় নিয়েছিল আমার প্রখর রোদের এক পশলা বৃষ্টি শ্রাবণী।

বন্ধু, গ্রিন ইউনিভার্সিটি বন্ধুসভা