আয়না
একটা সময়ে এসে বুঝি সবাইকে থেমে যেতে হয়। থামতে হয়। জীবনের ভ্রমণে সবাই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। কেউ কেউ প্রাণপণ চেষ্টা করেও থামতে পারে না স্বপ্নের বৃত্তে, স্বপ্নের পথে। যে স্বপ্ন একদিন সে নিজেই গড়েছিল, সেই স্বপ্নের পথটা একটা সময় তার কাছেই দুর্গম হয়ে ওঠে! স্বপ্নের আলোয় যে উদ্ভাসিত হয়েছিল, সময়ের কঠিন ধাক্কায় সে-ই হালছাড়া নাবিক। নিজেকে চরম ব্যর্থ ভাবে। অকপটে স্বীকার করে নেয় ব্যর্থতা। যা এর আগে কখনো করত না সে। পৃথিবীর রং ধূসর হতে থাকে দিন দিন। ফিকে হয়ে আসে ক্রমশ জীবনের যত আয়োজন। বিষাদ পুকুরের অতলে ডুবে যেতে থাকে নিজস্ব সময়গুলো। হাসি নেই, কান্না নেই, অনুভূতিহীন এক রোবট যেন। নিজেকে আর নিজের কাছেই ভালো লাগে না অনিকের। আয়নায় নিজের চেহারা দেখলে প্রচণ্ড রাগ হয় তার। আয়নার ওপর না তার নিজের ওপর? দুটির ওপরই তাই সে তার চারপাশের সব আয়না ভেঙে দিয়েছে। তার ঘরে কোনো আয়না নেই অনেক দিন ধরে। নিজেকে সে দেখে না অনেক দিন। দেখতেও চায় না। আয়নায় নিজেকে দেখলে অনিকের রাগ হয়, ঘৃণা হয় কিন্তু করুণা হয় না। নিজেকে করুণার পাত্র ভাবতে পারে না সে কখনো। যখন তাঁর জীবন উড়নচণ্ডী ছিল, প্রজাপতির মতো রঙের ছড়াছড়ি ছিল জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে তখনো যদি সে কখনো বুঝতে পারত তাকে করুণা করা হচ্ছে; খুব রেগে যেত অনিক।
করুণার বিষয়টি তার মাথায় আসে, কারণ সে ব্রোকেন ফ্যামিলি বয়। মা নতুন সংসার পেতেছেন কানাডার বরফে, অনিক যখন টুকটাক হাঁটা শুরু করে তখনই। বড়লোক বাবা, মায়ের সঙ্গে অনিককে দেননি, না, মা-ই নিয়ে যাননি—এ প্রশ্নের উত্তর কখনো খোঁজেনি অনিক। প্রয়োজন মনে করেনি। অনিকের বাবাও সংসার করছেন, দেশেই আছেন। সেই সংসারে অনিক থাকতে রাজি না হওয়াতে তাকে আলাদা বাসা দিয়ে দেওয়া হয়। মাস শেষে বাবা–মা দুজনই তার ব্যাংকে টাকা পাঠান। এত টাকাই জমে তার অ্যাকাউন্টে যে সে খরচ করার পথ পায় না। মাঝেমধ্যে ভাবে, এই টাকার প্রয়োজন তার নেই, তার প্রয়োজন শান্তির, বুক ভরে শান্তির নিশ্বাস নেবে। এক ফোঁটা সুখের। যা এই ব্যাংকভরা টাকা দিয়ে সে কখনো পায়নি। পাবে না।
মা কিংবা বাবা কারও সঙ্গেই তার দেখা হয় না, অনিকই দেখা করে না। কথা হয় না। মা পরবাসে, বাবা দেশেই, তবু কোনো সংযোগ নেই। অনিক অনেক সময় ভাবে, এমন স্বাধীন জীবন পেয়েও সে নষ্ট হয়নি। বখাটে হয়নি। জীবনকে নষ্ট করে দেয়নি। চাইলেই করতে পারত কিন্তু হয়নি। নিজের ভেতরে নিজেই দুমড়েমুচড়ে মরছে। হঠাৎ হঠাৎ একটা বৃদ্ধাশ্রমে যায় অনিক, সেখানের বয়স্ক নারী, পুরুষদের যত্ন করে, টাকা দিয়ে আসে। ওই সময়টাতে সে ভেতরে ভেতরে খুব ইমোশনাল থাকলেও তার ভালো লাগে। কিন্তু এসব ভালো লাগা খুব অল্প সময়ের। অনিক টের পায় তার বুকের ভেতর একটা পাথর, শক্ত একটা পাথর চাপা দেওয়া। সে চাইলেও ওই পাথরের জন্য কাঁদতে পারে না। পাথরটি গলাতেও পারে না। চাইলেই স্বাভাবিকভাবে বন্ধুদের সঙ্গে আগের মতো মিশতে পারে না। দিন দিন তার বন্ধুর সংখ্যা কমে আসছে। নিজেও অনুভব করে, সে দিন দিন অসামাজিক একটা জীবে পরিণত হচ্ছে বা হয়ে গেছে। তার ভালো লাগে না এখন আর এসব, দমবন্ধ লাগে। একমাত্র মানুষ তার জীবনে যে প্রথম আপনজন ছিল, রাবেয়া নামের মেয়েটি, সে–ও পরিবারের অজুহাত দেখিয়ে আজ অনিক থেকে শতবর্ষ দূরে, কোনো এক জাহাজের নাবিকের হাত ধরে সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরছে। পেছনের দিনগুলো যখন চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়, অনিক অস্থির হয়ে যায়, মেলাতে পারে না জীবনের অঙ্ক, মানুষের বদলে যাওয়া, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ যেন মানুষকে জানা। এত আপন মানুষগুলো কীভাবে দিন শেষে স্বার্থ আর নিজেদের ভালো থাকাকেই আঁকড়ে থাকে, অতীতের সব ভুলে, যে মানুষটা অতীতে কখনো নিজের দিকে তাকায়নি, প্রিয় মানুষজনের মুখে হাসি দেখার জন্য, সেই মানুষের সঙ্গে কীভাবে মানুষ মুখোশ দিয়ে মুখ ঢাকে। না পারে না, এসব হিসাব পারে না মেলাতে অনিক। তার দুনিয়া চরকির মতো ঘুরতে থাকে। নিঃসঙ্গ ঘরে পড়ে থাকে অনিক, ঘুম আসে না, তবু অন্ধকার করে ঘর শুয়ে থাকে। সেই অন্ধকারে আরও দু–একটি মুখ ভেসে ওঠে। আজ তাদেরও আলাদা করে ভাবার প্রয়োজন বোধ করে না অনিক। মনে মনে বলে, সবই এক। শুধু ছিল আপন হওয়ার বা দেখাবার বা সাজবার প্রয়োজন। জীবন অনেক দেখিয়েছে, সেই দেখা থেকেই শিক্ষা। পরপরই থেকে যায়, সাপ সাপই; যতই দুধ কলা দিয়ে পোষেন, যতই বুকের পাঁজর আগলে রাখেন, স্নেহ–ভালোবাসা দিয়ে, সময়ে মুখোশ খুলবেই। স্বার্থের স্রোতে সবাই-ই গা ভাসায়। খেয়া পার হয়ে গেলে মাঝিকে কে রাখে আর মনে!
অনিক জানে না আজ কেন সে এসব ভাবছে। কেন মনে পড়ছে তার এসব। বেশ কয়েক মাস ধরে অনিক একটা বিরক্তিকর অবস্থার মধ্যে আছে। নিজের মনের মধ্যেই এই জীবন, বেঁচে থাকা, বেঁচে না–থাকা নিয়ে তার ভেতরে তুমুল হুলুস্থুল চলছে। এর মধ্যে এসব ভাবনা তাকে আরও দুর্বল করে দেয়। পেছনের সময়, মুহূর্ত, দৃশ্য কিছু মানুষের মুখ সে ঝাপসাই দেখতে চায়, যেভাবে চোখ থেকে চশমা খুলে রাখলে পৃথিবীটা ঝাপসা লাগে তার।
প্রায় আট মাসের বেশি, অনিক নিজেকে দেখে না। মাঝেমধ্যে মুখে হাত চলে গেলে বুঝে মুখের মধ্যে দাড়ি বেড়েছে খুব। চুল হয়েছে অনেক বড় বড়। স্যালুনে যেতে হবে বলে, আসলে আয়নার সামনে যেতে হবে বলে তার আর দাড়ি কিংবা চুল কাটা হয় না।
খুব মায়ভরা এক অনুভূতি নিয়ে নিজের মুখে নিজেই হাত বুলাচ্ছে অনিক, হঠাৎ খেয়াল করল, তার চোখ ভেজা। তার মানে সে এতক্ষণ কাঁদছিল? অথচ এই কদিন সে অনেক চেষ্টা করেছে কাঁদতে পারেনি। বিছানা থেকে উঠে মুখটা ধুতে যায় অনিক, মুখ ধুতে ধুতে ভাবে জীবনে দুঃখ, কষ্ট, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা থাকবেই। জীবন আসলে একার, এখানে নিজেকেই লড়তে হয়। একা। অন্য কেউ এসে লড়বে না তোমার জন্য। এসব ভেবে অনিক সিদ্ধান্ত নিল, কাল দিন হলেই সব কটি আয়না লাগাবে আবার। স্যালুনে গিয়ে দাড়ি, চুল কেটে আবার স্বাভাবিক হবে। একটা চাকরি খুঁজতে হবে, যাতে বাবা-মার টাকা আর খরচ করতে না হয়।
ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় আসে অনিক। বৃষ্টি হয়ে গেছে বা হবে। শীতল বাতাস স্পর্শ করে যাচ্ছে। ভালো লাগছে তার, অনেক দিন পর ভালো লাগা বলে কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে তার। রাস্তার নিয়ন বাতিগুলো লাল আলো রাস্তার বুকজুড়ে বিছিয়ে দিয়েছে গালিচার মতো। দৃশ্যটি খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে অনিক। এরই মধ্যে আতকা কোথায় যেন মানুষের শব্দ শুনতে পায় অনিক, একটু ভালো করে লক্ষ করে দেখে, যেখানটায় নিয়নের আলো দেখছিল, তার থেকে আরেকটু পেছনে অন্য অরেকটি নিয়ন বাতির নিচে কয়েকটি ছেলে আর একটি মেয়ে! ছেলেগুলো রীতিমতো অত্যাচার করছে মেয়েটিকে গাড়িতে তুলতে, মেয়েটি গাড়িতে উঠবে না; আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে কিন্তু পারছে না। অনিক কী করবে বুঝতে পারল না প্রথমে, এরপর হুট করে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। দৌড় দিয়ে ওদের কাছে গিয়ে থামে। ছেলেগুলোকে বলে কী ভাই, কী হয়েছে, এ রকম করছেন কেন? ছেলেগুলোর প্রশ্নের উত্তরের আগেই মেয়েটি বলে ওঠে, ভাই, আমাকে বাঁচান, ওরা আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। আমি ওদের চিনি না। মেয়েটির মুখে ভাই শব্দ শুনে অনিকের কোথায় যেন খুব স্পর্শ করল, কে যেন তাকে কখনো এই স্বরে এই আকুতিমাখা কণ্ঠে ভাই ডাকত। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না অনিক। তিন-চারটি ছেলের সঙ্গে একাই লড়তে লাগল, সেই সময়ই কেউ একজন অনিকের তলপেটে চাকু ঢুকিয়ে দিল, লুটে পড়ল অনিক মাটিতে মুহূর্তে, নিয়নের লাল আলোর সঙ্গে তার লাল রক্ত মিলে যেন আরও চকমক করছে। যেন কেউ আয়না ধরেছে আর রিফ্লেক্স হচ্ছে।
রাস্তায় লাশ হয়ে পড়ে আছে অনিক, আর ওই দিকে তার ঘরে ঢুকে সবকিছু এক এক করে গাড়িতে তুলছে ছেলেগুলো আর ভাই ডাকা সেই মেয়েটি।
সাবেক সভাপতি, মৌলভীবাজার বন্ধুসভা